![]() |
কুয়ালালামপুর |
গভীর রাতে আপনারা যখন ঘুমিয়ে তখন আমরা উড়োজাহাজে করে পাড়ি দিচ্ছি বিশাল বঙ্গপোসাগর, আড়াই হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে হাজির হয়েছি টুরিষ্ট এর স্বর্গ রাজ্য মালেশিয়ায়। প্রিয় বন্ধুরা আজ স্বাগত জানাচ্ছি চোখ ধাঁধাঁনো শহর কুয়ালালামপুরে। লন্ডন কিংবা প্যারিসের মত এই কুয়ালালামপুর শহরটিও এক নজরে দেখে নেওয়ার সেরা উপায় “হপ অপ-হপ অন” নামের বিশেষ এক ধরনের বাস সার্ভিস। এইসব এয়ারকন্ডিশন ডাবল ডেকার বাসে চড়ে এক টিকেটে দিনভর আপনি চষে বেড়াতে পারেন সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন অত্যাধুনিক রাজধানী শহর। ঝকঝকে হাইরাইস, তকতকে রাস্তাঘাট আর প্রানবন্ত সিটি লাইফ দেখাতে দেখাতে চলমান বাস থামে প্রায় ২২ টি নামকরা স্থানে। দেখাদেখির জন্য যতবার ইচ্ছা নামা যায় বাস থেকে, উঠাও যায় পরবর্তী বাসে।
পেট্রোনাস টাওয়ার নাকি কেএল টাওয়ার কোথায় কোথায় নামবেন ইচ্ছাটা আপনার। কি দিনে কি রাতে কুয়ালালাপুরের যে প্রান্তে থাকুন নজর আপনার কাড়বে কুয়ালালামপুর টাওয়ার। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু টেলিকমুনিকেশান টাওয়ার গুলোর মধ্যে কুয়ালালামপুর টাওয়ার অবস্থান পঞ্চম স্থানে,নজরে না পড়ে উপায় আছে বলুন! কেএল টাওয়ার বা কুয়ালালামপুর টাওয়ার এর টিকিট কাউন্টার থেকে টিকেট কাটলে হাইস্পীড লিফট্ মাত্র ৫৪ সেকেন্ডে পৌঁছে দিবে ৯২০ ফুট উঁচু অবজারভেশান টেক এ। কুয়ালালামপুর টাওয়ার এর এই অবজারভেশান টেক দাঁড়ালে প্রায় পুরা কুয়ালালাম শহরটা নজরবন্দি। কেএল টাওয়ার আসলে মগডালের চুঁড়ো পাখির মত দৃষ্টি মেললে ধরা দে পুরো কুয়ালালামপুর। কেএল টাওয়ার নিজেই ১৪০০ ফুট উঁচু যেন ওর সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য পুরা শহর জুড়ে আকাশচুম্বী ভবনগুলার ছড়াছড়ি।
![]() |
পেট্রোনাস টাওয়ার |
মজার ব্যপার কি জানেন, মাত্র দেড়শ বছর আগেও এই কুয়ালালামপুর ছিল কর্দমাক্ত এক এলাকা। টিনের খড়ির খানাখন্দ ছাড়া কিচ্ছু ছিল না। অজ্ঞাত এই যায়গাটা কি এক যাদুর ছোঁয়ায় এতটাই বদলে গেছে যে সবাই এখন বলে আলফা ওয়ার্ল্ড সিটি। চোখ জুড়ানো একটি ভবন কুয়ালালামপুরের একটি নামকারা ল্যান্ডমার্ক। দেখতে সুন্দর আর রাজকীয় বলেই ত সুলতানের নামে নাম “সুলাতন আবদুল সামাদ।” মোঘল আমলের নজরকাড়া এই ভবন মালেশিয়ার সবছেয়ে বেশি ছবি তোলার একটি। বৃটিশ আমলে এই ভবনটি ছিল প্রসাশনিক কর্মকান্ডের প্রান কেন্দ্র, পরে হাইকোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। সংরক্ষিত হ্যারিটেজ বিল্ডিং হিসেবে এটি এখন মন ভরায় পর্যটকদের।
৩১২ ফুট উঁচুতে উড়ছে মালেশিয়ার পতাকা বিশ্বের সর্বচ্ছো ফ্ল্যাগ পোর্টে। ঢাকার সাভারে যেমন স্মৃতিসৌধ তেমনি কুয়ালালামপুরে টেক গার্ডেনে তেমনি ট্যাগু নেগারা। ট্যাগু নেগারা মানে ন্যাশনাল মনুমেন্ট। ৪৯ ফুট উঁচু গ্রানাইট সেনোটাফ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত জরুরী অবস্থা চলাকালে আত্মহুতি দেওয়া শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ। সেনোটাফ ছাড়াও ট্যাগু নেগারা চত্বরে আপনার নজর কাড়বে ক্রিসেন্ট আকৃতির সেন্ট্রাল প্যাভিলিওন পুস্পশোভিত রিপ্লেক্টিং পুল, পোয়ারা, উদ্যান এবং মূল স্মৃতিসৌধ। মূল স্মৃতিসৌধের উপর সাতটি সৈনিকে স্তম্ভ, এই সৈনিকেরা সাতটি ব্যঞ্জনার ধারক। নেতৃত্ব,কষ্টসহিষ্ঞুতা,একতা জাগ্রিতি,শক্তি,সাহস এবং আত্মত্যাগ। মানবতার জন্য, স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে প্রান দিয়েছেন যে যোদ্ধারা তাদেরই স্বরণে তৈরি হয়েছে এই ন্যাশনাল মনুমেন্ট।
ইস্তানা নেগারা মানে রাজার বাড়ি। রূপকথার গল্প নয়, সত্যি সত্যি রাজা আর রানী থাকেন ইস্তানা নেগারা নামক বাড়িতে। ফটকের ভিতরে এই রাজপথেরই শেষ মাথায় রাজবাড়ি। রাজবাড়ির ফটক ২৪ ঘন্টাই পাহারা দেয় শান্তি সেপাই। লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের মতই এখানের প্রহরীও দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রাজবাড়ি বলে কথা তাই পর্যটকদের ভীড় তাই লেগেই থাকে। রাজার বাড়িটি প্রায় ২৮ একর জমির উপর। উদ্যানে ঘেরা এই বাড়িতে সপরিবারে থাকেন রাজা টুংকু মিজান জয়নাল আবেদীন আর রানী নূর জাহিরা। বাড়ির ভিতরে ঢুকা পর্যটকদের জন্য একবারেই নিষেধ। বাড়ি যদি আপনারা দেখতে চান তাহলে বাইরে থেকে দেখতে হবে। অন্যসব দেশের মত প্রচুর বাংলাদেশী পর্যটকও বেড়াতে আসে মালেশিয়ায়। দেখতে আসেন এই রাজার বাড়িও।
এখানকার বুলেটিন বোর্ডগুলো আপনাকে জানাবে মজার এক তথ্য। বিশ্বে মালেশিয়া একমাত্র দেশ যেখানে রাজা বদলায় ৫ বছর পর পর। এই দেশের ৯ এলাকায় ৯ টি রাজ পরিবার। রাজা মনোনিত হন পালাক্রমে। ভেতরে ঢুকা না গেলেও বাইরের রূপ দেখে সময়টা আপনার ভালই কাটবে।
কুয়ালামপুরে সবচেয়ে আকর্ষনীয় টেম্পলটির নাম মাহামারিআম্বানি। টেম্পলটির প্রবেশধারে পাঁচ স্তরে দারুন ভাষ্কর্যশৈলী। মালেশিয়ার টেম্পলগুলার মধ্যে এটি যেমন খুব পুরাতন, অলংকরনেও তেমনি অনেক দামী। তাই ত কুয়ালামপুরের পর্যটন হিসেবে মন্দিরটি অন্যতম। ভারতের তামিলনাড়ু থেকে মালেশিয়ায় আসা হিন্দুরা কুয়ালালামপুরে এই টেম্পলটি নির্মান করেছে ১৮৭৩ সালে। দেবদেবী আর অবতার গুলির অধিস্থান এই টেম্পলে। আকর্ষনীয় এই টেম্পল একদিকে মালেশিয়ার হিন্দু দর্শনার্থীদের প্রানের অর্খ নিবেদনের মূল আঙ্গিনা অন্যদিকে ঐশ্বয্যে সৌকয্যে মালেশিয়ার অন্যতম হেরিটেজ।
![]() |
বিখ্যাত মাহামারিআম্বানি মন্দির |
টেম্পল থেকে বের হয়ে সামলে এগুলে স্বাগত জানায় নামকরা পেটালিং স্ট্রিট। বন্ধুরা কুয়ালামপুরের বুকে ঠিক মাঝখানটায় যে যায়গাটা কখনো ঘুমায় না আমরা সেই বিখ্যাত চায়না টাউনে। জোর দিয়ে বলতে পারি চায়না টাউনের মত এত ঝকঝকে, জমজমাট, প্রানবন্ত আর বৈচিত্র আর কোথাও পাবেন না। মনে হচ্ছে হাঁটছি ঢাকার গুলিস্তান কিংবা গাউছিয়া মার্কেটে। কুয়ালালামপুরের অন্য সব মার্কেট থেকে এই চায়না টাউন মার্কেট একেবারে আলাদা। চলাচলে সরুপথ আলোআধারি পরিবেশ দুপাশে হরেক রক পণ্যের পসরা। আসল নকল মিলিয়ে চায়না টাউনে আপনি পাবেন প্রায় সবধরনের পণ্য। দরকষাকষিতে আপনি কতটা এক্সার্ট সেটা প্রমানের দারুন সুযোগ এখানে। আসল চীনা খাবারের স্বাদ নিতে চাইলেও চায়না টাউনের মত ভাল যায়গা আর নেই।
অনেকের কাছে দিনের চেয়ে রাতের কুয়ালালামপুর বেশি মনমুগ্ধকর লাগবে। প্রিয় বন্ধুরা এখন আমরা এসেছি কুয়ালালামপুরে বিখ্যাত একটি রেস্তরায়। স্বাদ নিবো মালেশিয়ানদের খাবার আর দেখবো ওদের মনকাড়া সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সুর আর সঙ্গীতের তালে তালে নিতে পারবেন মালেশিয়ানদের খাদ্যের রসনাবিলাস, আসলে সোনায় সোহাগা। বহু জাতি বহু সংস্কৃতির এই দেশে মালয় ধারাটা মূল ধারা। পর্যটন বান্ধব কুয়ালামপুর দেখে আমরা ত মুগ্ধ আর আপনি? জানি আমার মত আপনাকেও টানছে মনকাড়া এই শহর। পর্যটনের স্বর্গরাজ্যে প্রতিটি স্পট মুগ্ধতায় ভরা।
0 Comments