অপূর্ব শোভামন্ডিত টেকনাফ পাড়ের জীবন

টেকনাফ

বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইব রোড ধরে ছুটে চলেছি আমরা উড়ে যাচ্ছি পাখির মত যেন রোমাঞ্চকর আভিযানের যাত্রী। প্রিয় বন্ধুরা টেকনাফের আজকের এই  অভিযানে আপনি চলুন আমাদের সাথে।ডানে সুনিল বঙ্গপোসাগর আর বামে সবুজ পাহাড়ের সুদীর্ঘ সারি। এখানটায় সাগরমুখী জলধারায় বাঁধা, কখনো নদী কখনো খাল, পার হচ্ছি সড়ক সেঁতুর সহায়তায়। একদিকে সাগরের হাতছানি অন্য দিকে এত সুন্দর রাস্তা দৃষ্টিনন্দন এই মেরিন ড্রাইব রোড কক্সবাজারের  কলাতলি সৈকত থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটার ধাবমান বাহনের সাথে সাগরের মাতাল হাওয়ার কানাকানি। পুরোটা পথ ধরে শুনাচ্ছে এডবেঞ্চারের গল্প। এই যেন স্বপ্নের যাত্রা। অনন্তের পথে সুন্দরের পানে। 

মেরিন ড্রাইব রোড আমাদের পৌঁছে দিয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সাগর সৈকত কক্সবাজারের শেষ অংশ টেকনাফে। এই টেকনাফ সৈকতের আশেপাশে যা কিছু আছে সারাদিন ঘুরে ঘুরে দেখবো। দিন শেষে আপনারাও আমার মত প্রেমে পড়বেন এই টেকনাফ সৈকতের। পাখিরা কত সুন্দরভাবে উড়ছে নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে। কক্সবাজার থেকে শুরু হয়ে ১২০ কিলোমিটার লম্বা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতটি শেষ হয়েছে টেকনাফে। পশ্চিম থেকে দক্ষিনে এই এই টেকনাফ সৈকতটির বিস্তৃতি প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। পাশেই আছে সৈকতের ঝাউবন। আকশ ছোঁয়া উঁচু উঁচু ঝাউ পড়েছে ছায়া ঢাকা এক মায়া বন। এই ঝাউ গাছ গুলো প্রায় ১৮ মিটার লম্বা হয়। এর পাতাগুলো লম্বা এবং সরু। ঝাউ গাছের এই সবুজ বেষ্টনি উপকূলীয় ঝড় জলোচ্ছ্বাস সামাল দিয়ে জীবন বাঁচায় জনপদ বাঁচায়। কেউ বলে বনঝাউ, কেউ বলে লালঝাউ আবার কেউবা বলে নোনাঝাউ। ঝাউ গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। নোনা মাটি আর উষ্ণ আবহাওয়ায় ভাল জন্মায়। সৈকতের ঝাউবীথি ছায়ায় হাঁটলে আমার মত আপনিও পাবেন প্রশান্তির ষোলআনা সুখ।

দসাগরতটে দেখবেন বাহারীসব নকশা, এগুলো করলো কোন শিল্পী! ভাটার সময় সৈকতের ক্যানভাস জুড়ে দেখা মিলবে বাহারী সব নকশা। নকশা শিল্পী লুকিয়ে আছে গর্তে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন ছোট ছোট কাঁকড়া এই নকশার কারিগর। কাঁকড়া গুলা বেশিরভাগই লাল। ভাটার সময়টায় খুবই ব্যস্ত ওরা গর্ত খুঁড়ার কাজে। ত্বক নির্মোচন, প্রজনন আর নিজেদের লুকিয়ে রাখার জন্য গর্ত ব্যবহার করে ওরা। পা এর সংখ্যা আট টি হলেও ওরা কিন্তু হাঁটে এবং দৌড়ায় ছয় পায়ে। 

টেকনাফ সৈকতে সারাক্ষন আঁছড়ে পড়ে ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর থেকে ধেয়ে আসা ঢেউ। ধেয়ে আসা ঢেউ বয়ে আনে হরেক রকমের শামুক,ঝিনুক ও কোড়ি। আর এসব ছোট ছোট বাচ্ছারা কুড়ায় সারা সৈকত জুড়ে। টেকনাফের ৫৫ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতে একগেয়েমির ঠাঁই নেই। নিশ্চুপ বসে আছি, মুগ্ধ নয়নে দেখছি, মগ্ন হয়ে শুনছি, সুনসান নিরবতার এখানে বসবাস বার মাস। পাহাড় লগ্ন সৈকতে দক্ষিনা বাতাস শুনাচ্ছে দূর দিগন্তের গান। সাগরতটের উচ্ছল উর্নিমালা অবিরল আঁকছে অবাক আল্পনা। অনেক শীলারশির সাথে সাগরের জলের প্রতিনিয়ত খুঁনসুঁটি। অদ্ভুত আকৃতির পাথর যেন একেকটা প্রানী, প্রকৃতির খেয়ালে গড়া একেকটা ভাষ্কর্য। সাগরজলের দস্যিপনা ঠেকাতে যেন সাগরতটে এত হাজার হাজার পাথর।

জোয়ার জলের সৌজন্যে সৈকতের খানা খন্দ গুলো যেন এখন প্রাকৃতিক মিউজিয়াম। ছোট ছোট হরেক রকমের মাছ গুলা ওসব গর্ত গুলাতে আটকা পড়েছে। আপন ভুবনে সাচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা রঙ্গের মাছ। জীববৈচিত্র, পরিবেশ আর প্রাকৃতিক নিসর্গ নিয়ে মাথা ঘামান যারা তাদের জন্য এই সৈকত আদর্শ বিদ্যাপিঠ। 

প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে গড়া এই সৈকতে কিন্তু পর্যটকদের তুলানায় জেলের সংখ্যাই বেশি। টেকনাফের এই সৈকতে মাছ ধরে নানা রকম জেলে। তাদের মাছ ধরার কায়দা কৌশলও নানা রকম। দড়িতে বাঁধা বাঁশের  লাঠি কোমরে বেঁধে পেছনে টানছে জেলেরা। দীর্ঘ এই দড়ির শেষ প্রান্তে বিশাল এক জাল। ট্রলারের সাহায্যে বিশাল যাগয়া জুড়ে ফেলানো হয়েছে শত শত হাত লম্বা জাল। সেই জালের দুই প্রান্তে বাঁধা দড়ি দুদিক থেকে টেনে পুরো জালটাই তুলে আনে ওরা। মাছ ভরা জাল অর্ধবৃত্তকারে টেনে তোলার কাজটা করে ওরা সবাই মিলে।  সাগরের ঢেউএর মত জেলেদেরও বিরাম নেই মাছ ধরার কাজে। সাগরে ফেলা এসব বিশাল জাল টেনে টেনে তীরে তুলে ওরা। ওদের দেখা দেখি আমরাও টানছি জাল, কাজটা কিন্তু অনেক কষ্টের। অনক শক্তি লাগে। এভাবে শুধু মাছ ধরে জীবিকা চলান টেকনাফের প্রায় ৯ ভাগ বাসিন্দা। জাল টেনে উপরে উঠানোর পর দেখা যাচ্ছে জালের ভাজে ভাজে তরতাজা মাছ। জাল তুললে ভীড় জমে, মাছ দেখার ভীড়। সমুদ্রের মাছ ত তাই দেখতে নানা রকমের বৈচিত্রের মাছ। সাগরের অগভীর অংশ থেকে মাছ ধরা হয় বলে ছোট মাছেই বেশি। 

মাছ ধরার দৃশ্য

                             কখনো জোয়ার কখনো ভাটা, ২৪ ঘন্টায় দুবার করে সাগর জলের এমন আসা যাওয়া চলতে থাকে অবিরাম।  জোয়ার ভাটার সাথে তাল মিলিয়ে জেলেদের ফিসিং ট্রলার গুলো পর্যায়ক্রমে গভীর সাগরে যায় এবং মাছ ধরে ফিরে আসে। ফিরে আসা ফিসিং ট্রলার গুলাকে পাড়ে তোলার জন্য আছে এক ধরনের চাকাওয়া ভ্যান। জলের স্রোতকে কাজে লাগিয়ে চাকাওয়ালা ভ্যানের উপর তোলা হয় ফিসিং ট্রলার। একই ভাবে ট্রলারের সামনে এবং পিচে দুই চাকার এসব ভ্যান দিয়ে টেনে তীরে উঠানো হয় ট্রলারগুলাকে। সাগর এখানে অগভীর আর জোয়ার ভাটার কারনে পাড়ের জলও ঘন ঘন যায়গা বদলায়, সেজন্য এইসব চাকার ভ্যানের ঠেলা গাড়ি দিয়ে ট্রলার গুলাকে তীরে উঠানো একটা ভাল বুদ্ধি। 

পোয়া, ল্যইট্টা, ছুরি, পাইস্য, রূপচাঁদা, শাপলাপাতা, কোরাল, বাটা, চিংড়িসহ নানা রকমের মাছ ।বঙ্গপোসাগর নাকি জোগান দে প্রায় ১৮০ প্রজাতির মাছ। জেলেদের ধরে আনা মাছগুলো সাধারনত নিলামে বিক্রি হওয়ার পর পাইকারদের মাধ্যমে চালান হয় সারাদেশে। 

টেকনাফের সৈকত

সুদীর্ঘ সৈকতের পাড় ধরে ভগ্ন পাহাড় সারি, যেন সাগরকে পাহারা দিচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে। চট্টগ্রাম পাহাড়শ্রেনীর বর্ধিতাংশটি মহেশখালী থেকে শুরু করে কক্সবাজার হয়ে শেষ হয়েছে টেকনাফে। এখানে এই জন্যই সারি সারি পাহাড়। কক্সবাজার জেলার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ও এই টেকনাফে। টারশিয়ারী যুগের এসব পাহাড় একসময় ছিল সমুদ্র গর্ভে। এখন এসব পাহাড় সৈকতের পাহাড়াদার। উঁচুতে ৬১ মিটার থেকে শুরু করে ২৬৮ মিটার পর্যন্ত। শিরউন্নত পাহাড় সারির গায়ে গায়ে যেমন বন বনানীর সবুজ সজ্জা তেমনি পাহাড়ের পাদদেশে নিসর্গধন্য জনবসতি। একেতো সাগর পাড় তার উপর পাহাড় একদমই পায়ের কাছে। প্রকৃতির পক্ষপাতটা এজন্যই বেশি। দারুন ছায়া ঢাকা, মায়া মাখা এখানকার গ্রাম, পাড়া, গৃহস্থ্যবাড়ি। নিসর্গধন্য এই জনপদে জীবন আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার। এখানকার বেশিরভাগ ঘরবাড়ি মাটি কিংবা বেড়ায় তৈরি। 

টেকনাফ এমনিতে বাংলাদেশের দক্ষিন পশ্চিম সীমান্তের শেষ উপজেলা তারউপর এখানকার গ্রাম গুলা সাগরঘেষা। স্থানীয় বাসিন্দারা তাই আক্ষরিক অর্থে প্রান্তিক মানুষ। প্রায় পৌনে তিন লাখ বাসিন্দা মাথাগুজার ঠাঁই করে নিয়েছেন টেকনাফের ৬ টি ইউনিয়নের ১৮৪ টি গ্রামে। মৎস প্রধান এই এলাকায় কৃষিও কিন্তু প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের জীবিকা। এখানকার গৃহনির্মানশৈলী একটু অন্যরকম কেনো তা জানতে চাইলে সবাই বলে ঝড় জলোচ্ছ্বাস এর কথা। উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় এখানকার ঘরবাড়ি গুলো অন্য এলাকার চেয়ে একটু আলাদা। দুই স্তরের চৌছালা ঘরগুলো নিচু করে বানায় বলে ঝড়ের দাপড় সইতে পারে। 

এবাড়ি ওবাড়ি সববাড়িতে নিচু নিচু ঘর কিন্তু উঁচু উঁচু অনেক গাছ। ঝড়ের দাপড় ঠেকানোর পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য বেশি বেশি গাছ লাগানো হয়েছে ঘরে বাইরে সবখানে। গাছগাছালি বেশি বলে ছায়া সুনিবিড় বাড়ি গুলোতে যেন একটা শান্তি শান্তি ভাব। বৈরী সাগরের রুদ্র মেজাজ এখানকার বাসিন্দারা নিয়মিত সামাল দে। ছোট ছোট ঝড়, জলোচ্ছ্বাস তো গায়েই মাখে না। সাগরের এতকাছে থাকা মানুষগুলোকে সাহসী না বলে উপায় নেই। কী সাহসী, কী শোভায়, কী বৈচিত্রে আসলেই মনকাড়া এখানকার গ্রামীন জীবন।

এখানকার সুপারি গাছ গুলা লম্বাতে প্রায় ৮০ ফুট। টেকনাফের সুপারি কিন্ত খুব নামকরা। কারন আকারে বড়, স্বাদে সেরা, কষের চেয়ে রসটাই বেশি। সৈকত ঘেষে গ্রামগুলাতে সুপারি শুধু গাছ নয়, রীতিমত বাগান আছে প্রায় বাড়িতে।  উষ্ঞ ও আদর্শ পরিবেশ পাওয়ায় এখানে সুপারির ফলন যেমন বেশি তেমনি আকার ও স্বাদের কারনে বানিজ্যিক চাহিদাও বেশি। হাটবাজারে টেকনাফের সদর বাজারের চেহারায় পাল্টে যায় সুপারির সমারোহে। প্রাচীনকালে বাংলাদেশের সুপারি ভারতের বন্দর হয়ে রপ্তানি হত মধ্যপ্রাচ্যে। আরবরা বলতো সোপারার ফল। এই কারনে নাকি সোপারা থেকে নাম হয়েছে সুপারি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এখানকার সুপারি পাইকারদের মাধ্যমে চালান হয় দেশের প্রায় সর্বত্ত্ব। অল্প বিস্তর রাপ্তানি হয় বিদেশেও। 

সুপারি

সুপারির সাথে পানেরও আবাদ কম নয় টেকনাফে। বাঁশের মাচানে চারপাশ ঘেরা এর স্থানীয় নাম বরজ। আর এই বরজের ভিতরে লাগানো হয় পান গাছ। ভেতরে ছায়া ছায়া পরিবেশে বড় হয় পানের গাছ গুলা। ঠিকঠাক মাটি, ছায়াময় পরিবেশ আর পানচাষীর যত্নে পান গাছ গুলা তরতর করে বেড়ে উঠে এখানকার বরজে। টেকনাফের কৃষিজীবিদের আয়ের  অন্যতম উৎস বরজের এই পান। সুপারির সাথে পাল্লা দিয়ে টেকনাফে নারিকেল গাছও আছে অনেক। সাগর পাড়ে বিধায় নারিকেল গাছগুলার স্বাস্থ্য খুব ভাল আর নারিকেল  গুলা বড়বড়।

সবুজে কি দারুন গালিছা,আকাশ ছোঁয়া অগনিত গাছ। যে কোন গাছের মূল ঐশ্বর্য গাছ গাছালি। আর এই ঐশ্বর্যের কোন কমতি নেই টেকনাফের এই বনে। হরেক রকম গাছের মাঝে সবচেয়ে বেশি দখলদারী দীর্ঘদেহী গর্জন গাছের। গর্জন চিরসবুজ বনের স্থায়ী বাসিন্দা। আকারে সোজা এবং সৌন্দর্য্যে রাজসিক। সরল ও উন্নত কান্ড নিয়ে ৪০ থেকে ৫০ মিটার পর্যন্ত হয় এই গাছ। 

টেকনাফের রঙ্গিন ট্রলার

টেকনাফ সৈকতে ফিসিং ট্রলারের অপরূপ রূপসজ্জা। আধখানা চাঁদ আকৃতির সারি সারি ট্রলার। মাথায়  পতপত করে উড়ছে পতাকা। একেক রংগের পতাকা একেক মহাজনের। দেখলে প্রথম নজরে মনে হবে বিরাট বালুকাবেলার সাদা ক্যানভাসে যেন রং বাহারীর আর্ট কম্পোজিসান। চাঁদ আকৃতির বিশেষ এসব ট্রলার সাগরের মাঝে মাছ ধরার প্রধান বাহন। আর কক্সবাজার সৈকতের শেষ প্রান্তে টেকনাফের এসব ট্রলার চোখে পড়ে সবচেয়ে বেশি।  

টেকনাফের সূর্যাস্ত

বহুরূপী সৈকতে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা, গধুলীলগ্নের কোনে দেখা আলোর দারুন সুখে আজকের মত বিদায় নিচ্ছি। প্রিয় বন্ধুরা আপনার আর আমাদের হৃদয়মাজারে টেকনাফের মধুময় এই স্মৃতি অভিরাম ডানা ঝাপটায় মুগ্ধ বিষ্ময়ে। 



Post a Comment

1 Comments