বহ্মপুত্র নদ |
প্রিয় বন্ধুরা আজ সারাদিন আছি বহমান নদ ব্রহ্মপু্ত্রের সাথে। ব্রহ্মপুত্র আসলে আবহমান কালের ধারা। বাংলাদেশের উত্তর মধ্যাঞ্চলের ভূগঠন, ইতিহাস, জনবল ও জীবনধারা বিকাশে কিংবদন্তি এই নদ জড়িয়ে আছে পরতে পরতে। একেতো নাম শুনলে প্রশ্ন জাগে মনে, নামখানা ব্রহ্মপুত্র কেন! তার উপর জেন্ডার নিয়েও সমস্যা নদী না নদ। পুরান মতে হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার মানসপুত্র বলে নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। আর মানসপুত্র হিসেবে নদী নয় নে নদ। নদ আর নদী নিয়ে ব্যকরনের আঙ্গিনায় অনেক বিতর্ক। বয়েধারা জলধারার সকলেই নাকি নদী নয়। কেউ কেউ নদ। মোটা দাগে বলা যায় উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত বয়ে চলা পথে যে জলস্রোত জন্মদেয় শাখা প্রশাখার সেই নদী, আর উৎসস্থল থেকে আকের নদীর সংগে মিতালী হওয়া পর্যন্ত যে ধারা বিস্তার ঘটেনি কোন শাখা প্রশাখায় সেই নদ।
ব্রহ্মপুত্রের যমুনামুখী ধারা বুকে নিয়েছে চারটি উপনদীর পানি। ধরলা,দুধকুমার,তিস্তা আর করতোয়া আত্রাই। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের আদি ধারাটি ব্যকরনের সঙ্গা না মেনে ঠিকই জন্ম দিয়েছে বংশী,শেরকালী ও সুতিয়া নামের ছোট্ট শাখা নদী। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকা ৫৮ টি বড় নদ-নদীর একটি এই ব্রহ্মপুত্র। বাংলাদেশে এই নদ ঢুকেছে কুড়িগ্রামের সীমান্ত জনপদ দাতভাঙ্গা ইউনিয়ন দিয়ে। ব্রহ্মপুত্রের উৎসস্থল কোথায় জানেন! সুদূর তিব্বতে। ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান তিন নদী প্রনালীর একটি। ব্রহ্মপুত্র,যমুনা,পুরাতন ব্রহ্মপুত্র,তিস্তাসহ অনেকগুলা শাখা ও উপনদীর সমবায়ে এই প্রনালী গড়ে তুলেছে দেশের বৃহত্তম প্লাবনভূমি। উজান থেকে বয়ে আনা পলি জমিয়ে অন্য সব বড় নদীর মত ব্রহ্মপুত্রও বাংলাদেশ নামের বঙ্গীয় ব-দ্বীপ করেছে হাজার হাজার বছর ধরে।
শুকনো মৌসুমে বহ্মপুত্র |
বছরে প্রায় ৭২৫ মিলিয়ন টন পলি বয়ে আনে এই নদ। বুক জুড়ে তাই এই নদে চরের সমারোহ। ছোট বড় মিলিয়ে অসংখ্য চর আছে এই নদ এ। নদের মন্থরগতির কারনে নিন্মে প্রবাহ অংশে পলি জমে জমে সৃষ্টি হয় এসব চরের। কোন কোন চর বর্ষায় ডুবে যায় পানিতে, শুকনো মৌসুমে জেগে উঠে আবার। বিস্তৃর্ণ প্রান্তর তখন হয়ে উঠে গবাদিপশুর আদর্শ চারনভূমিতে। নদের পলি আর পানি পেয়ে চরের মাটি উর্বর খুব। শুকনো মৌসুমে তাই নানান শস্যে ভরপুর থাকে নদঘেষা চরে। বহতা ব্রহ্মপুত্রের পানির প্রধান উৎস দক্ষিন পশ্চিম তিব্বতে। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৯০০ কিলোমিটার।
বাংলাদেশে যমুনাকে সাথে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়েছে প্রায় পৌনে তিনশ কিলোমিটার পথ। কুড়িগ্রামের বোমারি থেকে যমুনামুখি ধারাটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৯ কিলোমিটার আর বাহদুরাবাদের উজান থেকে দক্ষিন পূর্বগামী পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিছে প্রায় ২০৭ কিলোমিটার পথ। পুরনো ব্রহ্মপুত্র ঢাকা বিভাগের প্রধান জলাধারা। উজানের উত্তর পশ্চিম কোন থেকে যাত্রা শুরু করে এই নদ এগিয়েছে দক্ষিন পূর্বের ভাটিতে। চলার পথে সে আপন করেছে জামালপুর,ময়মনসিংহ,নরসিংদি ও কিশোরগঞ্জ জেলার মানুষের জীবন জীবিকা। অম্ল নাকি মধুর জানি না, ব্রহ্মপুত্রের সাথে যমুনার সম্পর্ক একটু অন্যরকম। সম্পর্কের শুরু প্রায় শোয়া দুইশ বছর আগে। প্রথমে ১৭৮২ সালের ভূমিকম্প, পরে ১৭৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যা বদলে দে বহ্মপুত্রের গতিপথ। তখন গড়ে উঠে যমুনা নদীর মূলধারা।, বহ্মপুত্রের বেহাল অবস্থা শুরু তখন থেকে। চীনের তিব্বত,ভারত এবং বাংলাদেশে নদ প্রভাবিত এলাকার আয়তন প্রায় ৫ লাখ ৮৩ হাজার বর্গকিলোমিটার, এর মাঝে বাংলাদেশে পড়েছে প্রায় ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার।
আমরা দেখতে আসলাম চরপাড়ের মানুষের জীবন ছবি দেখতে চরপাড়ের গ্রামে। একজন লোক জানালো চরের নাম চর জেলখানা। বাপ দাদা দের কাছ থেকে শোনা। অনেককাল আগে নাকি এখানে জেলখানা তৈরি হওয়ার কথা ছিল এই চরে। শেষ পর্যন্ত জেলখানা তৈরি না হলেও গ্রামের নাম হয়ে গেছে চরজেলখানা। ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ছায়াসুনিবিড় এই গ্রামটি পড়েছে ময়মনসিংহের কতুয়ালি থানা জনপদে। নদীর চরে গড়ে উঠা এই গ্রামে নানা পেশার বাসিন্দারা বাস করছে প্রায় তিন যুগ ধরে। বহ্মপুত্র নদের মত জীবন এখানে চলে ঐতিহ্যের ধারায়। শুধু চর জেলখানা নয়, বহ্মপুত্রের প্রায় সব জনপদই গ্রামীন জীবনের ঐশ্বর্য্য আর প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় ভরা।
মানচিত্রে বহ্মপুত্র নদ |
জীবন যাত্রায় যুগ বদলের হাওয়া লাগলেও এখানে মেঠো পথে এখনো হাঁকিয়ে চলে ঐতিহ্যবাহী মহিষের গাড়ি। সুবিধা বঞ্চিত চরজনপদ হলে কি হবে নতুন প্রজন্মের বাচ্ছারা এখানে আগুয়ান শিক্ষার সরনীতে। বয়সের কারনে গতি এবং পানি কমলেও দানের ক্ষমতা কমে নি এখনো। অগনিত মানুষের জীবন জীবিকার এখনো অন্যতম উৎস এই নদ। বাহাদুরাবাদের উত্তরে বহ্মপুত্রের নদের বাম দিক থেকে উৎপন্ন হওয়া পুরনো এই বহ্মপুত্র নদ কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাজারে মেঘনার সাথে মিলিত হওয়ার আগে ময়মনসিংস জেলাকে ভাগ করেছে পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশে।
জনপদের ক্যানভাসে এঁকেছে সমৃদ্ধির আঁচর। বহ্মপুত্র পাড়ের জীবন ছবি দেখার আদর্শ যায়গা ময়মনসিংহ শহরের উত্তর প্রান্তসীমায় গড়ে উঠা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সংগ্রহশালা। এই যে হৃদয়ে হৃদয়ে কথা, জীবনের ভাঙ্গা গড়া, এক বেলা গড়িয়ে অন্য বেলার পালা সবই দেখে বহ্মপুত্র। বয়সের ভারে তার ধার কমলেও পড়ন্ত বেলার রূপ মাধুরীর মত ভাললাগায়, ভালবাসায় এখনো সে প্রানের পল্গুধারা। বহ্মপুত্রের মত এমন ধারা আছে বলেইতো এতটা মনকাড়া রূপময়ী এই বাংলাদেশ।
0 Comments