প্রশান্তির দ্বীপ সেন্টমার্টিন

সেন্টমার্টিন দ্বীপ

যুগে যুগে ভ্রমনের তাগিদে মানুষ হয়েছে অভিযাত্রী। ভ্রমন পিপাসুদের ভ্রমন কাহিনী শেষ হয়েও যেন হয়না শেষ। তাইতো ভ্রমন মানুষের আদিম ইচ্ছা ও আকাঙ্খাও বটে। বন্ধুরা আজ ছুটে যাচ্ছি ভ্রমনের নেশায় কোন এক অজানা প্রান্তে। মাথার উপরে অনন্ত আকাশ, প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তরে অখন্ড বাংলাদেশের সর্বদক্ষিন জনপদ টেকনাফের বদরমোখাম, পশ্চিমে বঙ্গপোসাগর ও আরব সাগরের বিপুল বিস্তার, ১৪ কিলোমিটার পূর্বে পাহাড়ি নাফ নদী আর মায়ানমার উপকূল, দক্ষিনে বঙ্গপোসাগর ও ভারত মহাসাগর ছাড়িয়ে এন্টার্টিকা পর্যন্ত অসীম সমুদ্র আর পায়ের নিচে ২০ লাখ বছরের পুরনো প্ল্যাস্টোসিন আমলের মাটি। প্রিয়  ন্ধুরা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন আমরা কোথায় আছি। হ্যাঁ ঠিকই অনুমান করতে পারছেন, এসেছি বাংলাদেশের সর্বদক্ষিনের দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। 

সাগরভাসা এই দ্বীপ থেকে খালি চোখেই দেখা যায় হাতছানি দিয়ে ডাকা মায়ানমারের পাহাড়সারি। শুনা যায় ধেয়ে আসা অগ্নিমালার বয়ে আনা দূরদিগন্তের গান। সাগর জলের দস্যিপনা ঠেকাতে চারদিকে পাথরের কোলাজ এই দ্বীপের বেলাভূমি জুড়ে। আসলে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে কেউ প্রশান্তির দ্বীপ বললে ভুল হবে না। এই দ্বীপের সবখানেই স্নিগ্ধ প্রশান্তির অপূরান ভান্ডার। উত্তর দক্ষিনে বিস্তৃত এই দ্বীপের আয়তন জোয়ার ভাটার সাথে তাল মিলিয়ে কমে আর বাড়ে। জোয়ারের সময় থাকে ৫ বর্গকিলোমিটারের মত আর ভাটার সময় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ বর্গকিলোমিটারে। 

এই দ্বীপে ট্রলার গড়ার কারিগরের বেশ কদর, ট্রলারের কারিগরা জানালেন গর্জন গাছের একটি ট্রলার বানাতে খরচ পড়ে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। দ্বীপের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই জেলে। জাল ওদের অস্ত্র আর ট্রলার ওদের বাহন। দিনের সূর্য আর রাতের তারা দেখে ওরা দিক নির্ণয় করে। দরিয়ার রং দেখে বুঝে পানির গভীরতা। আর আকাশের রং দেখে বুঝে আবহাওয়ার গাতি প্রকৃতি। সেন্টমার্টিনকে ঘিরে রাখা বঙ্গপোসাগরের আবহাওয়া খারাপ থাকে মে মাস  থেকে আগস্ট সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সাগর থাকে শান্ত। স্থানীয়দের ভাষায় পুকুরের মত আর ঠিক এই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি মাছ ধরে এই দ্বীপের জেলেরা। মাছের জন্য  প্রতিক্ষা আর প্রস্তুতির পালা সেরে সেন্টমার্টিনের জেলেরা প্রতিদিন এইভাবে জীবিকার তরী ভাসায় বেলা অবেলার জলস্রোতে। 


ভাটার সময় সেন্টমার্টিন

বাঁশের মাচায় ভরা শুটকি মাছের দেখা মেলে দ্বীপের সৈকত জুড়ে। সুরমা, রূপচান্দা, ল্যইট্টা, পোয়া, কোরাল, শাপলাপাতা সহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের শুটকি হয় এখানে। শুটকি মাছের কথা শুনলে জ্বিবে পানি আসে না এমন মানুষ নাই বললে চলে। মাছের যোগান বেশি হলে দ্বীপে মাছ শুকিয়ে শুটকি করার আয়োজনটাও সমান তালে চলে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায় তাজা মাছের বিপণন এই দ্বীপে তেমন জমে না, বিকল্প উপায় তাই রোদে শুকিয়ে শুটকি করা। এই দ্বীপের  শুটকি প্রথমে চালান হয় টেকনাফে, সেখান থেকে কক্সবাজারের চট্টগ্রাম হয়ে ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। সেন্টমার্টিনের মানসম্মত শুটকি মাছ রপ্তানি হয় বিদেশেও। 

বঙ্গপোসাগর নামে উপসাগর হলেও আকার আয়তন আর গভীরতায় কিন্তু বিশ্বের বড় সাগরগুলারই একটি। সেন্টমার্টিনকে বুকে নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বউপদ্বীপ এলাকায় এর অবস্থান। বঙ্গপোসাগরের সাথে বাংলাদেশের মিতালী গড়ার যায়গাটা ফানেল আকৃতির হওয়ায় প্রতিবছরই সইতে হয় ঝড়,ঝঞ্ঝাটের আগ্রাসন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এইটুকু এই দ্বীপটাকে ঝড়,ঝঞ্ঝাট যেনো এড়িয়ে চলে। অন্য এলাকায় প্রলয় কান্ড ঘটলেও ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড়গুলো সেন্টমার্টিনকে ছাড় দিয়ে যায় বারবার। স্বরণকালে তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে নাই এই দ্বীপ এ। পূর্ব সীমানায় পাহাড় সারি আর ভূ-তাত্ত্বিকভাবে সুবিধাজনক থাকায় সিডরের মত ঘূর্ণিঝড়গুলো বরাবরই এই দ্বীপকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় টেকনাফের উত্তর পূর্বদিকে। জলোচ্ছ্বাসের সময়ও দ্বীপ এলাকায় জোয়ারের পানি ততটা বাড়ে না। দ্বীপবাসীদের তাই গর্ব, গত ১০০ বছরেও নাকি একটি নৌকাও  ডুবে নাই এই দরিয়ায়।  

প্রশান্তির দ্বীপ

টেকানাফ থেকে আসা যাত্রীবাহী জাহাজ সীট্রাক ও ট্রলার গুলো প্রতিদিন এসে ভিড়ি দ্বীপের এই জেটি ঘাটে। সকালের দিকে এসে নৌযান গুলা আবার ফিরেযায় বিকালবেলায়। প্রতিদিন এভাবে আসে হাজার হাজার পর্যটক তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে স্বপ্নের দ্বীপ সেন্টমার্টিন দেখতে। সেন্টমার্টিনে পা রাখা যাত্রীদের বেশিরভাগই দূরদূরান্ত  থেকে আসা ভ্রমনপিয়াসী। ভ্রমপিয়াসীদের কেউ কেউ যারা এডবেঞ্চার প্রিয় তাদের অনেকে যান সেন্টমার্টিনের সর্বদক্ষিনে পাথুরে দ্বীপ ছেঁড়াদিয়া তে। জীবন্ত প্রবালের উপনিবেশ দেখতে চাইলে স্কুবা ড্রাইবারের সাহায্য নিয়ে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন সাগর তলে। বঙ্গপোসাগরের প্রধান দুই আকর্ষন জোয়ার এবং ভাটা। ২৪ ঘন্টায় দুবার করে এরা বদলে দেয় সৈকতের রূপ। ভাটার সময় পানি সরে যায় দূরে জোয়ারের সময় উতলে উঠে আবার। 

ব্রিটিশ আমলে সেন্টমার্টিন ছিল জঙ্গলে ঘেরা বিরান এক দ্বীপ। তখন ধনাঢ্য এক ব্যক্তি দ্বীপটি কিনে নেন। পরে তিনি দ্বীপটি আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেন। তিনিই এই দ্বীপে প্রথম বসতি গড়ার উদ্যেগ নেন। জীবনের জাগরনে চেয়ে যাওয়া ছোট এই দ্বীপে জীবন চলে প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে। সেন্টমার্টিন আগে ছিল টেকনাফ থানার একটি অংশ।  ১৯৮৩ সালে এটি ৯ ওয়ার্ডের আলাদা ইউনিয়ন। প্রাইমারি স্কুল এবং হাইস্কুলও আছে এই দ্বীপে। আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য সাইক্লোন সেন্টার। আট দশটা জনপদের মতই এই দ্বীপের  চাষীরাও কৃষিজীবি জীবন ধারার স্নিগ্ধতা ছড়ায় ফসলের মাঝে। মাটি তেমন সুবিধার না হলেও  চারশ একর জমিকে চাষাবাদের উপযোগী করে নিয়েছে এখানকার চাষীরা। জমিতে ফসল হয় দুইবার। রোপা ধান উঠে গেছে চাষ হয় তরমুজের। দ্বীপের মাত্র ২৯ ভাগ জমি আবাদযোগ্য। সেই জমির বেশিরভাগটাই আবার বেলেমাটিতে ভরা। বেলে মাটি পানি ধরে রাখতে পারে না বলে সবসময় পানি সেচ দিয়ে ফসল ফলাতে হয়। এটাই চাষীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। 

নয়নাভিরাম দ্বীপ

দারুন ছায়া ঢাকা, মায়া ভরা এই দ্বীপে গ্রাম, কৃতিত্বটা অগনিত নারিকেল গাছের। গ্রামের একেকটা বাড়িতে একশ দেড়শ বা তার বেশি  নারিকেল গাছ। গৃহকর্তা জানালেন দ্বীপের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বাসিন্দা কমবেশি সকলে নারিকেল গাছের কাছে  ঋনী। এই গাছ তাদের ছায়া দে, ঘরবাড়ি বাঁচায় ঝড় ঝঞ্ঝাট থেকে আর নিয়মিত যোগান দেয় ডাব, নারিকেল এবং জ্বালানির। সেন্টমার্টিনের ডাবে জলের পরিমান যেমন বেশি স্বাদেও তেমন অতুলনীয়। ১৩০০ বছর আগে বানিজ্য তরী নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আরব বনিকরা এই দ্বীপকে বলতো জাজিরা, প্রায় এস নোঙ্গর ফেলতো এই দ্বীপে।  লোকমুখে জাজিরা একসময় হয়ে যায় জিঞ্জিরা, এই দ্বীপে অগনিত নারিকেল গাছ থাকায় একসময় এর নাম হয়ে যায় নারিকেল জিঞ্জিরা। বৃটিশ আমলে রাজকীয় নৌবাহিনী বঙ্গপোসাগরে জরিপ চালাতে এসে এই দ্বীপের নতুন নাম চাপিয়ে দেয় সেন্টমার্টিন, যা আজও অক্ষয় হিসেবে আছে। 

দ্বীপটি চারভাগে বিভক্ত, উত্তর পাড়া,মধ্য পাড়া, দক্ষিন পাড়া, এবং ছেঁড়াদিয়া। আকর্ষনীয় গ্রামের সংখ্যা বেশি উত্তর পাড়া এবং মধ্য পাড়ায়। সেন্টামার্টিন এস অনেকেরই নজর এড়িয়ে যায় এসব গ্রামের প্রকৃতি ও মিলবন্ধন। সেন্টমার্টিন দ্বীপে আত্মহারা ভ্রমনপিপাসু দিনদিন বাড়ছে এই দ্বীপে। আগতদের মাঝে তরুন ভ্রমনপিয়াসীরাই বেশি। এই দ্বীপে বেড়ানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী। প্রকৃতির রূপ বৈচিত্র দুচোখ মেলে দেখা, চেনা ও জানার আদর্শ যায়গা এটি। পর্যটকদের ঠাঁয় দিতে দ্বীপের এখানে ওখানে গড়ে উঠেছে ছোট বড় বেশ কয়েকটি হোটেল ও কটেজ। আছে স্বল্প খরচে বাসা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থাও। পর্যটন সুবিধা মেটানোর আকর্ষনীয় এইসব কাঠামো পর্যটকদের সুযোগ করে দিয়েছে সেন্টমার্টিনকে আরও চেনা জানার। পর্যটকদের খাবারের চাহিদা মেটাতে আয়োজন আছে সৈকতেও। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য ধারেকাছে মিলবে সুমিষ্ট ডাবের পানি। কেউ কেউ সুন্দর মূহুর্ত্ব বন্ধি করে ক্যামেরার ফ্রেমে। স্বপ্নদ্বীপের হাতছানিতে ভ্রমপিপাসুরা এখানে আসে ব্যস্ত জীবনের পিছুটান ফেলে। ঘুরে বেড়ায় আবিস্কারের আনন্দ নিয়ে। প্রতিদিন দিনান্তে সেন্টমার্টিন সাজে সূর্যাস্তের অপরূপ সোনা রঙ্গে। 









Post a Comment

0 Comments