গ্রামীন নয়নাভিরাম দৃশ্য |
প্রকৃতির রূপ ও ঐতিহাসিক নিদর্শনে ভরা এই দেশের পরতে পরতে রূপের স্নিগ্ধতায় সাজিয়ে রেখেছে গ্রামীন প্রান্তর। এই রূপের মহিমায় মোহিত হয়ে আজ চলছি আমরা বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে জেলা জনপদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ। পদ্মা, মেঘনা,যমুনা কিংবা গোমতী বা কর্নফুলীর মত খরস্রোতা নয়, ভরা বর্ষাতেও প্রবাহ তার প্রশান্ত। স্নিগ্ধ এই নদীর নাম মহানন্দা। দারুন সখ্যতা তার নবাবগঞ্জের মানুষের সাথে। মহানন্দা অনেক প্রাচীন নদী, মহাভারতে এর উল্লেখ আছে নন্দা নামে। এই নদীর উৎপত্তি সুদূর হিমালয় পর্বতমালার মহালাধিরাম পর্বত থেকে। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, মালদহ জেলার বুক ছিড়ে আসা এই মহানন্দ নদী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ঢুকেছে ভোলাহাট উপজেলা দিয়ে। মহানন্দার দানে নদীর দুই পাড় ফসলে রাঙ্গানো সুজলা-সুফলা। চাষাবাদ ও গৃহস্থালীর নানা প্রয়োজন মিটিয়ে দুপাশের জীবন ধারায় এই নদী মিশেছে নিবিড়ভাবে। মহানন্দার মত পুনর্বভা,গঙ্গা নদীও প্রাণের স্পন্দনে রূপের ছটায় সমৃদ্ধি এনেছে এই নবাবগঞ্জ জনপদে।
রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে উত্তরবঙ্গের এক গুরুত্বপূর্ন জেলা জনপদ এই নবাবগঞ্জ, স্থানীয়রা বলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ১৯৪৭ সালের আগে এই নবাবগঞ্জ ছিল মালদহ জেলার একটি থানা জনপদ। রাজশাহী জেলার অধীনে আসে দেশভাগের সময়। মহকুমা ঘোষিত হয় ১৯৪৮ সালে। জেলার স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৮৪ তে। উপযুক্ত মাটি ও আবহাওয়া পেয়ে এই জেলায় দারুন আমের বাগান গড়ে উঠেছে প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জুড়ে। আমের বাম্পার ফলনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খ্যাতি সেই মুঘল আমল থেকে। আম গাছ উষ্ণমন্ডলীয় বৃক্ষ। গাছ থেকে নানা কৌশলে আম পাড়া শুরু হয় মুলত জৈষ্ঠ্য মাস থেকে। প্রজাতিবেদে একেক রকমের আম পাড়া হয় একেক মাসে। আম চাষীদের কাছ থেকে পাইকাররা কিনে সাধারনত বাগান হিসেবে। কিনে নেওয়া বাগান থেকে আম সংগ্রহ করে পাইকাররা প্রথমে পাঠায় স্থানীয় হাট বাজারে পরে সারা দেশে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত আম |
কাসা পিতলের তৈজসপ্রত্র বানানো কাসারুরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রাচীন পেশাজীবিদের অন্যতম। ওরা কাজ করে দলবেঁধে। একজনে দড়ি বেঁধে রোলারে যুক্ত কাসার পাত্র ঘুরায় অন্যজনে ধার দেওয়া ছুরি দিয়ে কাসা পিতল মসৃন করে আর নকশা আঁকে। এদেরকে বলা হয় পিতলের কারিগর। কলস,ঘটি,বাটি,থালা,আগুনদানি,গোলাপদানিসহ নানান ধরনের টেকসই জিনিস ওরা বানায়। কাসা পিতলের জিনিস সহজে নষ্ট হয়না বলে তারা পুরাতন পিতল কাসার জিনিসও ব্যবহার করে কাঁচামাল হিসেবে। আগুনে গলানো কাসা নির্দিষ্ট ছাঁচ এ ফেলে আলাদা আলাদা অংশ ওরা বানিয়ে নেয় আগে। এক অংশের সাথে অন্য অংশ জোড়া দিতে ওরা ব্যবহার করে হাঁফরে জ্বালানো কাঠ,কয়লার উষ্ণতা। যুগের চাহিদা বদলে যাওয়ায় উপযোগীতা কমলেও কাসা পিতলের তৈজসপত্র বানিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাসারুরা এখনো ধরে রেখেছে হাজার বছরের ঐতিহ্য।
এই জনপদের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাকা সড়ক ও ৪৫ কিলোমিটার আধাপাকা রাস্তা এবং ৩৩৫ কিলোমিটার কাচা রাস্তা ও ৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল পথ নিয়ে। এই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা বুকে ধরে আছে সদর, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, নাচোল, গোমস্তাপুর নামের ৫ টি উপজেলা। ১ হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এই জনপদের শিক্ষার হার উন্নিত করেছে ২৪ শতাংশের উপরে। এই জেলার আয়তন প্রায় ১৭৪৫ বর্গকিলোমিটার। এর ৫ টি উপজেলায় ৪৫ টি ইউনিয়ন ৭৮৫ টি মৌজা আর ১১৩৬ টি গ্রাম। একদিকে এটি উত্তরবঙ্গের গ্রাম অন্যদিকে ছোঁয়া পেয়েছে বরেন্দ্রভূমির। তাই এখানে গ্রামজীবনে স্নিগ্ধতা পরতে পরতে। ঐতিহ্যবাহী নানা পেশার কারিগর নিয়ে এই জেলা জনপদের জনসংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। নবাবগঞ্জের সমতল গড়ে উঠেছে বরেন্দ্রভূমি আর নদীসৃষ্ট চরাঞ্চল নিয়ে। উর্বরতায় এই জনপদ তাই শস্য শ্যামল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পেশাজীবিদের প্রায় ৩৫ ভাগ সরাসরি কৃষি কাজে নিয়োজিত। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দেয় আরও প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ। এই জনপদের চাষযোগ্য জমির পরিমান প্রায় ১ লক্ষ ৩৩ হাজার হেক্টর। ফসলি জমিতে সেচের পানির নামকরা এক যোগানদার এক ঐতিহ্যবাহী বিল। বিলটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩ কিলোমিটার আর প্রশস্ত কোথায় কোথাও দেড় কিলোমিটারের। এছাড়াও বিভিন্ন বিল এর সাথে স্থানীয় জনজীবন জড়িয়ে আছে বিভিন্ন লেনদেনের বাঁধনে।
বিখ্যাত সোনা মসজিদ |
এই জনপদের ফিরোজপুরে ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদ, নজরকাড়ে সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলীর উৎকর্ষে। উত্তর-দক্ষিনে ২৫ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৬ মিটার লম্বা এই মসজিদের প্রতি কোনে ৮ কোনাকার চমৎকার বুরুচ। তিনটি চৌচালা আর ১২ টি গোল গম্বুজ রয়েছে এই মসজিদের ছাদ জুড়ে। পূর্ব দেয়ালে ৫ টি বড় প্রবেশপথ। বেলে পাথরের ৮ টি স্তম্ভ ভেতরের নামাজের যায়গাকে ভাগ করেছে ৩ সারিতে। প্রাচীন এই মসজিদের নির্মাণ ১৫ শতকের সুলতাল আলাউদ্দিন হুসেনশাহ এর আমলে। কষ্ঠি পাথরের কারুকাজ করা এই মসজিদ গঠনশৈলী আর সৌকর্য্য বিন্যাসে অতুলনীয় এক কীর্তি। মসজিদ প্রঙ্গনের দক্ষিন পূর্ব কোনে আছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এবং মেজর নাজমুল হকের কবর। মসজিদের পূর্ব সীমানায় শায়িত আছেন মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহাম্মদ বীন আলী সহ তাঁর সতীর্থরা।
নবাবগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে এলে চোখে পড়ে স্থলবন্দরের চালচিত্র। এপাড়ে বাংলাদেশের সোনামসজিদ স্থলবন্দর আর ওপারে ভারতের মহদ্বীপপুর স্থলবন্দর। দুদেশের বিভিন্ন ধরনের মালামাল আনানেওয়া হয় এই বন্দর দিয়ে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কতৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত এই বন্দর সচল রেখেছে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তে দিয়ে পন্য আনা নেওয়ার সুবাধে সরকারের রাজস্বখাতে প্রতিবছর আয় হয় কয়েকশো কোটি টাকা। নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তে আমদানি ও রপ্তানি বানিজ্যের চলমান কর্মযজ্ঞের গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই স্থলবন্দর। কী প্রত্নকৃর্তীর গরিমায়, কী প্রকৃতির সৌকর্য্যে, কী জীবনধারার ভৈববে নবাবের মতই ঐশ্বর্য্য এই নবাবগঞ্জ।
0 Comments