রাঙ্গামাটি |
আয়তনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং পার্বত্য জেলাগুলার মধ্যে একটি রাঙ্গামাটি। প্রাচীনকালে এই জেলায় প্রচুর পরিমানে কার্পাস তুলা পাওয়া যেত যার নামানুসারে কার্পাস মহলে ছিল এই জেলার প্রাচীন নাম। বর্তমানে এখানকার রূপ বৈচিত্র্যের খ্যাতি পেয়েছে রূপের রানী হিসেবে। পাহাড়,নদী ও লেক বিষ্টিত একটি বৈচিত্রময় জনপদ যেখানে রয়েছে চাকমা,মারমা,রাখাইন সর্বপরি বাঙ্গালীসহ ১৪ টি জনগোষ্ঠির বসবাস। প্রকৃতির অফার সৃষ্টি এই জেলা বাংলাদেশের পর্যটনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
রাঙ্গামাটি জেলার জনপ্রিয় ভ্রমনস্থান গুলো হল কাপ্তায় হ্রদ, ঝুলন্ত সেতু, শুভলং ঝরনা, সাজেক ভ্যালি, নৌবাহিনীর পিকনিক স্পট, কাপ্তায় বাঁধ, কাপ্তায় জাতীয় উদ্যান, বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রউফ স্মৃতি ভাষ্কর্য, উপজাতীয় যাদুঘর, কর্নফুলী কাগজ মিল,বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ ইত্যাদি। কাপ্তায় লেক পার্বত্য চট্টগ্রামে বুকে প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তায় উপজেলা। কাপ্তায় উপজেলা অনন্য পাহাড়, লেকের অথৈ জলরাশি এবং চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহ।
নয়াভিরাম কাপ্তাই লেক |
১১ হাজার বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই কৃত্রিম হ্রদ দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে আয়তনে সর্ববৃহৎ। এখানে চোখে পড়ে ছোড়বড় পাহাড়, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, ঝর্না আর জলের সাথে সবুজের মিতালী। একদিকে যেমন রয়েছে পাহাড়ের উদ্ভিদ তেমনি লেক এর অথৈ জলে রয়েছে বহু প্রজাতির মাছ ও অপুরন্ত জীববৈচিত্র। লেকের চারপাশের পরিবেশ ছোট ছোট দ্বীপ, নানা রকমের পাখি এবং জলকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রা আপনাকে মুগ্ধ করে রাখবে প্রতি মুহুর্ত্ত্ব। কৃত্রিম হলেও প্রকৃতি তার সমস্তরূপে উজাড় করে সাজিয়েছে কাপ্তায় হ্রদকে। বছরের সবসময় কাপ্তায় ভ্রমনের জন্য যাওয়া যায়, তবে বর্ষায় লেকের পাশের ঝর্নাগুলো পরিপূর্ন রূপের দেখা মেলে।
রাঙ্গামাটির আরেকটি আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট এর নাম ঝুলন্ত ব্রীজ। পর্যটন প্রেমী মানুষের কাছে রাঙ্গামাটি জেলার একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পর্যটকদের মোহিত করতে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র। এর মধ্যে কাপ্তায় হ্রদের উপর নির্মিত ৩৩৫ ফুট লম্বা ঝুলন্ত ব্রীজ রয়েছে সবার পচন্দের শীর্ষে। রাঙ্গামাটিতে আসা সকল পর্যটকই সিম্বল অব রাঙ্গামাটি হিসেবে খ্যাত ঝুলন্ত সেতুটি দেখতে আসেন। কাপ্তাই লেকের বিচ্ছিন্ন দুই পাহাড়ের মধ্যে সম্পর্ক করে দিয়েছে রঙ্গিন এই ঝুলন্ত সেতু। এই সেতুতে দাঁড়িয়ে কাপ্তায় লেকে মনোরম সৌন্দর্য্য অবলোকন করা যায়। ব্রীজের এক পাশে পাহাড়ের উপর শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে দোলনা, স্লীপার ইত্যাদি। ঝুলন্ত ব্রীজ এ প্রবেশ এর জন্যে পর্যটন কর্পোরেশনকে জন প্রতি ২০ টাকা ফি দিয়ে টিকিট কাটতে হয়।
দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্তব্রীজ |
শুভলং ঝর্ণা রাঙ্গামাটির আরেকটি দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র। রাঙ্গামাটি সদর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দুরত্বে শুভলং বাজারের পাশে শুভলং ঝর্ণার অবস্থান। বাংলাদেশের অন্য সকল জেলার ঝর্নার মত শুকনো মৌসুমে শুভলং ঝর্নার পানি কম থাকে। বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১৪০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে বিপুল জলধারা কাপ্তাই লেকে আছড়ে পড়ে। এছাড়া শুভলং ঝর্না দেখতে যাওয়ার পথে এর সৌন্দর্য্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। দুই পাহাড়ের মধ্যে বয়ে যাওয়া লেক দেখে অন্য দেশ মনে করে ভ্রম হতে পারে। শুভলং ঝর্নার সৌন্দর্য্য পর্যটকদের বিমোহিত করে। উপরের পাহাড় থেকে পাথরের মাটিতে ঝর্ণা ধারা আছড়ে পড়ার দৃশ্য মুগ্ধ করবে সবাইকে। এই ঝর্নাতে চাইলে স্নানও সেরে নিতে পারেন এবং হতে পারেন অন্যরকম অভিজ্ঞার সাক্ষী।
শুভলং ঝর্ণা |
রাঙ্গামাটি জেলার দৃষ্টিনন্দন আরেকটি পর্যটন স্পর্ট হচ্ছে হ্যাপি আইল্যান্ড। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই লেকের কোল ঘেষে হ্যাপি আইল্যান্ড এর অবস্থান। মনোরম সবুজ প্রকৃতি ও চমৎকার নির্মাণশৈলীর এই দ্বীপটি মূলত একটি ওয়াটার পার্ক। প্রায় ৪৫ একর যায়গা জুড়ে একটি মাছের আকৃতির আদলে ভিন্নধর্মী আয়োজন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই হ্যাপি আইল্যান্ড। এই পার্কে আছে ওয়াটার রাইড এবং সুইমিংপুলসহ আকর্ষনীয় নানা উপকরন। সারি সারি গাছ দিয়ে সুসজ্জিত হ্যাপি আইল্যান্ড পার্ক সব বয়সী মানুষদের ভাল লাগার মত একটি যায়গা। এছাড়াও এখানে আছে পিকনিক করার যাবতীয় সুব্যবস্থা কপিশপ ও মৎসকন্যার ভাষ্কর্য। বর্তমানে শিশু কিশোরসহ সকল বয়সের মানুষের অন্যতম স্থান হিসেবে হ্যাপি আইল্যান্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এই জেলার অন্যতম আরেকটি পর্যটন স্পর্ট রাজবন বিহার। বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্মের বৃহত্তম বিহার রাজবন বিহার রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত। রাঙ্গামাটির দর্শনীয় স্থানগুলার মধ্যে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষন হয় এই রাজবন বিহার। ধর্ম দার্শনিক বৌদ্ধধর্মীয় নেতা শ্রদ্বেয় সদানন্দ মহস্তমির ১৯৭৭ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রাঙ্গামাটিতে আসেন। তাঁর শীর্ষদের বসবাসের জন্য এই বিহারটি নির্মান করা হয়। বৌদ্ধদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই বিহার বর্তমানে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত হয়েছে। শুধু বৌদ্ধধর্মালম্বীদের জন্য নয় পার্বত্য অঞ্চলে এই ধর্মজ্ঞান চর্চা কেন্দ্রটি দুনিয়ার সব প্রকৃতিপ্রেমী, সৌন্দর্য্য ঘনিষ্ঠ ও জ্ঞান সাধক মানুষদের জন্যই।
রাজবন বিহার |
পলওয়েল পার্ক নামে দৃষ্টিনন্দন পর্যটনস্পর্ট রয়েছে এই রাঙ্গামাটিতে। রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশি তত্ববধানে কাপ্তায়লেকে কোলঘেষে অবস্থিত পলওয়েল পার্ক সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় রাঙ্গামাটি জেলার অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বৈচিত্রময় ল্যান্ডস্কেপ, অভিনব নির্মাণশৈলী ও নান্দনিক বসার স্থান পার্কটিকে দিয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা। নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটাতে চিত্রবিনোদের জন্য প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীর পদচারনায় পলওয়েল পার্ক মুখর হয়ে উঠে। এছাড়া এখানে পিকনিক ছাড়াও ভিবিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ রয়েছে।
এবার আমাদের গন্তব্য কমলক ঝর্নার কাছে। কমলক ঝর্না দেখতে সাজেক ভ্যালী থেকে দুই আড়াই ঘন্টার ট্যাকিং করতে হয়। সাজেকভ্যালীর পাহাড়ের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখার পর আরও রোমাঞ্চিত হতে চাইলে ঘুরে আসুন কমলক ঝর্নাতে। তবে এর জন্য সাজেকভ্যালীতে একদিন অবস্থান করা ভাল। কমলক ঝর্নার স্থানীয় নাম সিকাম তৈয়ছা। সুন্দর ঝিরিপথ ধরে চলতে চলতে বিভ্রান্ত হতে পারেন কিংবা অতি বর্ষনে কোথাও কোথাও ঝিরিপথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, সুতারাং প্রথমবার ঝর্নাটি দেখতে গিয়ে থাকলে একজন গাইড অবিশ্যই নিয়ে যেতে হবে। বর্ষা মৌসুমে ঝিরিপথ বেশ পিচ্ছিল থাকে আবার মাঝে মাঝে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে ও নামতে হয়। তাই সতর্ক থাকুন সবসময়।
লেকের দৃশ্য |
এবাব চলে আসলাম রাঙ্গামাটির জেলার আরেকটি পর্যটন কেন্দ্র লেক ভিউ আইল্যান্ডে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তায় লেকে গড়ে তোলা হয়েছে এই লেক ভিউ আইল্যান্ড। এই আইল্যান্ডে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কটেজ, হিলটপ সুইমিংপুল, এ্যাডবেঞ্চার পার্ক এবং মাছ ধরার সুব্যবস্থা। কাপ্তাই লেকে ঘুরে বেড়ানো এবং রাত্রি যাপনের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে নীলকৌড়ি নামক ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের অভিযাত নৌকা। কাপ্তাই লেকের নিকট টিলায় নির্মান করা হয়েছে হিলটপ রিসোর্ট। চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন প্রকৃতির রঙ্গে রাঙ্গানো নয়নাভিরাম রাঙ্গামাটিতে।
0 Comments