মায়াভরা শেরপুর জনপদ |
আজ চলতে চলতে আমাদের গন্তব্য বগুড়ার শেরপুর জনপদে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে দেখবো শেরপুর মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারা। প্রিয় দর্শক স্বাগত জানাচ্ছি শস্য শ্যামল শেরপুরে। ফসলের মৌসুমে শেরপুরের ভুট্টা ছেয়ে থাকে দিগন্ত ছোঁয়া সবুজের বিশাল গালিচায়। শেরপুর জেলা জনপদ নয়, বগুড়ার শেরপুর উপজেলায়, জেলা জনপদের মত আয়তনের ব্যাপ্তি না থাকলেও এই উপজেলার বুকে ঐশ্বর্য্যের কমতি নেই। ফসলের প্রাচুর্য্যের ভরা এই শেরপুর বগুড়া জেলার দক্ষিনের প্রান্তিক জনপদ। প্রায় ২৯৭ কিলোমিটার আয়তনের এই উপেজেলার চারদিক ঘিরে আছে বগুড়া সদর, রায়গঞ্জ, তাড়াশ, ধুনট এবং নন্দিগ্রাম উপজেলা। শেরপুরের জমিনে জলের যোগান দে করতোয়া ও বাঙ্গালীসহ বেশ কয়েকটি নদী আর অনেকগুলো বিল। নদী আর বিলে বেশ মাছ ধরা পড়ে জেলেদের জালে।
বগুড়ার এই শেরপুর উপজেলা রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১৭৮/১৮০ কিলোমিটার দূরে। থানা জনপদ হিসেবে শেরপুরের প্রশাসনিক মর্যাদা ১৯৬২ সাল থেকে। উপজেলায় রূপান্তরিত হয়েছে ১৯৮৩ তে এসে। এই উপজেলার বুকে ঠাঁই পেয়েছে ৯টি ওয়ার্ড আর ১৮টি মহল্লা। শেরপুরের খন্দকারতোলায় এলে নজর কাটবে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট্য একটি মসজিদ। মোঘল আমলে এই যায়গার নাম ছিল শেরপুর মোর্চা। মোর্চা অর্থ দূর্গ। মাটির দেয়ালে ঘেরা সেই দূর্গ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে, রয়ে গেছে দূর্গের ভিতরে ১৫৮২ সালের বানানো খয়ের গা নামের এই মসজিদটি। এটি শেরপুরের সবচেয়ে প্রাচীন মুসলিম নিদর্শন। ফার্সি ভাষায় লিখা এই শিলালিপি বলছে এই মসজিদের নির্মাতা মির্জা বুরাদখান কাকশাল। ইটের তৈরি এই মসজিদের নির্মাণশৈলীতে প্রাক মুঘল যুগের বৈশিষ্ট্য খুব স্পষ্ট। বক্রাকার কার্নিশ আর পোড়ামাটির অলংকরন তারই প্রমান। প্রাক মোঘল যুগের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য থাকলেও মসজিদের ভূমি পরিকল্পনা কিন্তু মোঘল ঘরনার। আয়তকার এই মসজিদটি আয়তনে প্রায় ৫৭ ফুট লম্বা আর প্রস্থে সাড়ে ২৪ ফুট। আট কোনাকার গম্বুজ আছে মসজিদের প্রতি কোনে। শেরপুরের ৪৪৩ টি মসজিদের মধ্যে এতি সবচেয়ে নামকরা।
মসজিদ |
শেরপুরে আবাদযোগ্য জমির পরিমান প্রায় ২৪ হাজার হেক্টরের মত। নদী খাল বিলের অভাব নেই বোলে সেচের সুবিধা আছে বেশিরভাগ জমিতে। একেতো ৯৫ ভাগ সেচের সুবিধা আছে ৯৫ ভাগ জমিতে তারউপর জমিও খুব উর্বর। শেরপুরে তাই বছরে দুবার ফসল ফলে ৬৭ ভাগ জমিতে আর তিন বার ফসল ফলে ১৭ ভাগ জমিতে। এই জনপদের সবচেয়ে বেশি ফলন ধানের। ধানের সাথে তাল মিলিয়ে দিনদিন বাড়ছে ভুট্টার চাষও। শেরপুরে ধানের চাতাল চোখে পড়ে অনেক। ধান ধোয়া, সেদ্ধ করা, রোদে শুকানো, ধান ভানা এবং শেষে বস্তায় ভরে বাজারজাত করা এসব কাজ চলে চাতালে পালাক্রমে। প্রচুর ধান জন্মে বলে শেরপুরে রাইস ও ফ্লাওয়ার মিল আছে শতাধিক। রাইসমিল প্রতিদিন শতশত টন ধানকে পরিনত করে খাবারযোগ্য চাল এ। এই জনপদের প্রায় ৪৯ ভাগ পেশাজীবি ফসল ফলায়। কৃষিতে পরোক্ষভাগে শ্রম দে আরও প্রায় ২৪ ভাগ মানুষ। চাতাল বা রাইসমিলের শ্রমিকরাও তাদের সাথে শরিক। এখানকার নামকরা এক খাদ্যপণ্য মিষ্টি স্বাদের দই। বগুড়ার নামকরা দই এর কথা কে না জানে। বিখ্যাত এই দইয়ের একঅংশ যোগান দে শেরপুরের দই আলারা। প্রায় দেড়শতাধিক দই বিক্রেতা দই তৈরি করেন শেরপুরে। রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে রয়েছে এই দইয়ের কদর। জ্বাল দেওয়া গরম দুধ প্রথমে কারিগরেরা ঢালে দই পাত্রে। দইকে ঘন এবং সুগন্ধি করতে চুলার আঁচ লাগে, দুধ ঢালার পর দই পাত্রগুলো ঢেকে রাখা হয় বিশাল পাত্র দিয়ে। ঠান্ডা হওয়া দই পাত্রে ছাঁচ দই মিশেয়ে রাতভর রেখে দিলে সকালে মিলে সুগন্ধি ও সুস্বাদু দই, আর এই দই শেরপুরসহ যোগান দে সারাদেশে।
বগুড়ার বিখ্যাত দধি তৈরি |
চোখ জুড়ানো ফসলের জমি তারই পাশে মাথা গোজার ঠাঁই। জীবন ও জীবিকার এক অপরূপ সংমিশ্রন চোখে পড়ে শেরপুরের গ্রামে গ্রামে। বাংলার চিরন্তন জীবন ধারা দেখতে আসতে হয় গ্রামে। শেরপুরে গ্রাম আছে প্রায় ৩১৩ টি। এই জনপদের বেশিরভগ বাসিন্দারই ঠিকানা এই গ্রামে। শেরপুরের ৩১৩ টি গ্রামের অবস্থান ৯ টি ইউনিয়নের ২৩১ টি মোজায়। টিনের চাল আর মাটির দেয়ালে গড়া ঘরবাড়ি বেশি এখানকার গ্রামে। পরিবেশ বান্ধব ঘরগুলোর দেয়াল বেশ চমৎকার। বাহারি নকশা করা থাকে ঘরের মাটির দেয়াল গুলোতে। নগর জীবনের যন্ত্রনাগুলা দেখা মিলে না গ্রামে। সুযোগ সুবিধা অর্থবিত্তের জাঁকজমক হয়ত নেই, কিন্তু জীবন এখানে সহজ, সুন্দর, সাবলীল। শেরপুরের গ্রামীন জীবনধারা চিমচাম পরিপাটি হয়েছে আসলে পরিশ্রমের গুনে। কি পুরুষ কি নারী সকলে ব্যস্ত এখানে কোন না কোন কাজে। বসে থাকে না কেউই। এখানকার গৃহবধূদের সময় কাটে কাঁথা সেলাই করে। গৃহস্থলী কাজে শেষে অবসর পেলেই তারা বসে যায় কাঁথা সেলাতে। কেউবা কাঁথা সেলাই করে বিক্রি করে আবার কেউ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাঁথাতে তোলে নিপুন হাতের নজরকাড়া নকশা।
পানির যোগান দেওয়া খাল |
বাঁশের কাজ, কাঠের কাজ, তাঁতের কাজ, মাটি কিংবা লোহার কাজ সব কাজেরই কারিগর আছে শেরপুরে। এই জনপদে লোহা দিয়ে পণ্য তৈরি করে প্রায় ৬২ ঘর কামার। শেরপুরের সবচেয়ে নামকরা মন্দির প্রাঙ্গনটি ভবানীপুরে। নজরকাড়া এই মন্দিরটির নাম বারোদুয়ারি শিব মন্দির। সংস্কার করার কারনে এই মন্দিরটি এখনকার মনে হলেও এই মন্দির ২৬৪ বছরের পুরোনো। শেরপুরে মন্দির আছে ৫১ টির মত। ভবানীপুরের এখানটায় মুল মন্দির সহ ৮ টি মন্দির। কোনটায় আরাধনা হয় দেবতা শিব এর আর কোনটা দূর্গতিনাশীনি দূর্গার। শেরপুরের ধর্মপ্রান রানী ভবানী বেশ কয়টি মন্দির গড়েছেন এখানে। তারগড়া শিবমন্দিরটি বাবা পিঙ্গেশ্বরের নামে। নানা ধর্মের নানা পেশার মানুষ মিলিয়ে সমৃদ্ধ এই জনপদের জনসংখ্যা প্রায় দুই লাখ ত্রিশ হাজারের মত। ফসলের প্রাচুর্য্য, শিল্পের গরিমা, ইতিহাসের দীপ্তি প্রকুতির ঐশ্বর্য্য, জীবনের রং রূপ বৈচিত্র কি নেই বগুড়ার এই শেরপুরে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য বিলিয়ে দেওয়া এই জনপদের মত অনেক জনপদের সমন্বয়ে গড়া রূপময় এই বাংলাদেশ।
0 Comments