মৃৎপাত্র |
এই মৃৎপল্লীর খামারপাড়ায় প্রায় ৪০ ঘর কুমার আর নরপাড়ায় আছে প্রায় ৯৫ ঘর কুমার। অতি সাধারন উপাদান আর যন্ত্রপাতি দিয়ে মৃৎপাত্র তৈরি করে কুমাররা। ঘূর্ণায়মান চাকার উপর মাটির মন্ডে আকৃতি দেয় দক্ষ হাতের ছোঁয়ায়। পুরাতত্ত্বিকদের ধারনা বিশ্বে মৃৎশিল্পের চলন শুরু হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। আর বাংলাদেশের ভূখন্ডে মাটির এই চাক বিশেষ এক শিল্প হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বছরেও আগে। কলসির ব্যবহার আগের তুলনায় কমে গেছে অনেক। তাই কুমাররা কলসি কম করে তৈরি করে এখন। মৃৎশিল্প আসলে এক পারিবারিক কর্মযজ্ঞ। আর কাজ চলে ধাপে ধাপে। একজনে মাটির মন্ড বানিয়ে দে, আর সে মন্ড দিয়ে আরেকজন তৈরি করে হরেক রকম তৈজসপত্র। আধুনিকতার মিশলে চমৎকার সব টব বানায় এখানকার কুমাররা। বাহারি এই টবের প্রচুর চাহিদা এই শহরে। মৃৎশিল্পে আধুনিকতা আসছে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। অতীতেরর শিল্প নৈপুণ্য আর বর্তমানের প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মৃৎশিল্প হয়ে উঠেছে আরও আকর্ষনীয়। সাধারনত মৃৎশিল্পের গায়ে যখন পড়ে শিল্পীর আঁছড় জন্ম নেয় শিল্পের আরো বেশি শোভা।
নিপুন হাতের মৃৎপাত্র তৈরি |
কুমাররা মাটির কাজকে আসলে যে শিল্প বলে গণ্য করে তার প্রমান পাওয়া যায় শরৎকালে। এই সময় হিন্দু কুমাররা দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়েন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ঐতিহ্যের পরম্পরায় পূর্বজনদের নৈপুন্য জ্ঞান সঞ্চারিত হয় ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতেও। তাদেরও মৃৎশিল্পের হাতেখড়ি হয় এখান থেকেই। শিমুলিয়ার কুমাররা নিত্যপণ্যের পাশাপাশি নান্দনিক পণ্য তৈরিতেও সমান উদ্যেগী। আগে থেকে বানিয়ে রাখা ছাঁচ দিয়ে দিনে প্রায় ১০/১২ টা ফুলদানি তৈরি করে। মৃৎপাত্র কেউ বানায় ঘুর্ণায়মান চাকা দিয়ে কেউবা বানায় ডাইস দিয়ে। ইতিহাসের অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেও মৃৎপাত্র তৈরির কায়দা কৌশলে পরিবর্তন আসে নি তেমন। একইরকম সহজসরল আগের মতই সবকিছু। শুধু বাহারি ডিজাইনে এসেছে নান্দনিকতা। শিল্প নৈপুণ্য আর রূপবৈচিত্র্যে এখানকার প্রতিকৃতি খেলনা পুতুল আর ঘর সাজানোর জিনিসগুলা আসলেই মনকাড়া। আধুনিক ডিজাইনের টবের পাশাপাশি পুরনো ঘরনার বড় বড় হাড়ি পাতিলও তৈরি করেন শিমুলিয়ার এই কুমাররা। শুধু দৈনন্দিন ব্যবহারের সাধারন মৃৎপাত্র নয়, খেলনাপুতুল, মাটির ব্যাংক, হাড়ি পাতিল, মুর্তি,ফুলদানি, দই পাত্র ইত্যাদি নানান ধরনের মৃৎশিল্প তৈরি করে এখানকার মৃৎশিল্পীরা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে দেশীয় জীবন সংস্কৃতির ধারা।
বাংলাদেশ ভূ-খন্ডে মৃৎপণ্যের ব্যবহার সভ্যতার সেই সূচনা লগ্ন থেকে। ঐতিহ্যবাহী এসব মৃৎপণ্য বুকে ধরে আছে বাঙ্গালীর আবহমান জীবনধারার কত গল্পগাঁথা। কি নারী কি পুরুষ! কুমারদের কাজ শুরু ভোর সকালে আর চলে গভীর রাত পর্যন্ত। কর্মযজ্ঞের চাকা এখানে ঘুরে অষ্টপ্রহর। মাটির কাজ আর ঘর গৃহস্থালীর সাথে কুমার মেয়েদের আজীবনের সখ্য। মৃৎপাত্র পোড়ানোর বিশেষ চুলা একেক যায়গায় একেক নাম। এসব চুলায় পুড়ে পুড়ে কাঁচা মাটির পাত্র পায় স্থায়ী রূপ। নিচে আগুন জ্বালানোর পৌকষ্ঠ, উপরে টিনের চালার নিচে খড় ও কাদার আস্তরনে ঢাকা মৃৎপাত্রের স্তুপ। একরাশ ধোঁয়া ছড়িয়ে চুলার জ্বলন্ত জ্বালানি মৃৎপাত্রগুলোকে প্রায় ২৪ ঘন্টা একটানা পোড়ায়। চুলার উপরে থরে থরে সাজানো মৃৎপাত্রগুলো ঠান্ডা হলে খালাসের পালা শুরু বিক্রির জন্যে। শিমুলিয়ার মৃৎপাত্র হাঁটে নিয়ে বিক্রি করতে হয় না। পাইকারের লোক এসে কিনে নিয়ে যায়। নৌকা ভরে ভরে মৃৎপণ্য পাঠায় ধামরায় ও সাভারে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে কোন কোন আইটেম রপ্তানি হয় বিদেশেও।
বিক্রির জন্য প্রস্তুত |
মাটির পাত্র বোলে আমরা হয়তো মৃৎপাত্রের তেমন একটা পাত্তা দি না, অথচ আমাদেরই এই মৃৎপণ্য রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ৫২ টি দেশে। আর এই থেকে বছরে আয় হচ্ছে শতাধিক কোটি টাকা। কুমারপাড়া বলে এখানে পণ্য বিনিময়ে পণ্য পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম মৃৎপাত্র। পরিবর্তন এসেছে যুগ আর জীবনধারায়, অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে মৃৎশিল্প। ধাতব ও প্লাস্টিক সামগ্রীর দাপটে পরিবেশ বান্ধব মাটির জিনিসের চাহিদা কমছে দিনদিন। বেড়ে চলেছে উৎপাদন খরচ। আয় ব্যয়ের হিসেব মিলাতে না পেরে কুমারদের কেউ কেউ ছেড়ে দিচ্ছে বংশ পরম্পরার এই পেশা। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তাই কার্যকরী সহযোগীতা দরকার রাষ্ট্রের। হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য আর সৌন্দর্য্যমন্ডিত এই মৃৎশিল্পকে কুমাররা আঁকড়ে ধরে আছে জীবনের সাথে। যেন নদীর মতই ওরা বয়ে চলেছে জীবন সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য এক ধারা।
0 Comments