‘পাট’ বাংলার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক

পাট গাছ

প্রিয় বন্ধুরা আজ আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলাদেশের সোনালী আঁশ নিয়ে। পাট বাংলাদেশের অর্থকারী ফসলের পাশাপাশি এটি বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক বাহক। পাটের আবাদ শুরু চৈত্র বৈশাখ মাসের প্রাক বর্ষায়। বৃষ্টির পানি বেশিক্ষন থাকে না এমন দোঁআশ মাটি পাটের জন্য বেশি উপযোগী। আগাচা দমন, চারা পাতলা করা এবং মাটি আলগা করার জন্য পাট ক্ষেতে প্রথম নিড়ানি সাধারনত দেওয়া হয় ১৫ থেকে ২১ দিনের মধ্যে এবং দ্বিতীয় নিড়ানি দেওয়া হয় ৩৫ থেকে ৪২ দিনের মধ্যে। বাম্পার ফলনের জন্য ইউরিয়া ছাড়া আর কোন সার লাগে না পাট চাষে।

এ গাছের সর্বাঙ্গ সবুজ, পাতা গুলা লম্বা চওড়ায় বড় ঘন সবুজ, মসৃন ও চকচকে। চার প্রজাতির পাট জন্মায় দেশে, কেনাফ ও মেস্তা কম পরিমানে আর দেশী ও তোশা বেশি পরিমানে। দেশী সাদা পাট এর বৈজ্ঞানিক নাম করকোরাস ক্যাপসোলারিস। পাট এর লিকলিকে শরীর দ্রুত বর্ধনশীল। এই পাট লম্বায় হয় সর্বোচ্ছ ১৪ ফুট পর্যন্ত। এক হেক্টর জমির পাট, প্রতি ১০০ দিনে বায়ু থেকে প্রায় ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষন করে ফিরিয়ে দে প্রায় ১১ টন অক্সিজেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধে পরিবেশ বান্ধব এই পাট অনন্য এক বিকল্প। 

চাষীরা পাট কাটতে শুরু করে ৪ থেকে ৫ মাসের মাথায় আষাঢ় শ্রাবন মাসের ভরা বর্ষায়। পাট ফলে দেশের প্রায় সব জেলায়। সবছেয়ে বেশি জন্মায় ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুরে। উষ্ণ আর্দ  জলবায়ু আর পলিময় মাটির কারনে বাংলাদেশের কৃষকের ফলানো এই পাট গুনে মানে বিশ্বসেরা। বাংলাদেশের ৮ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে বছরে উৎপাদিত হচ্ছে সাড়ে ১৬ লাখ টনের বেশি  পাট। কাটার পর আটিবাঁধা পাট গাছ সাধারনত ঝাঁক দেওয়া হয় আশেপাশের জলাশয়ে। আড়াআড়ি এবং লম্বালম্বি করে রাখা আটির স্তুপ চাষীরা জলমগ্ন করে এমনভাবে যেন জাগের মধ্যে পানি এবং পাট পচানোর ব্যাকটেরিয়া জীবানু সহজে যেতে আসতে পারে। সাধারনত ২ থেকে ৩ সাপ্তাহ পানির মধ্যে রাখলে পচে যায় গাছের বাকল। গাছের কান্ড থেকে বাকল আলাদা করার পর অল্প স্রোতে ভাল জলে ভাল করে ধুইলে বেড়িয়ে আসে কাঙ্খিত আঁশ। ঝাঁক দেওয়ার কায়দা পচনের মাত্রা আঁশ ধোয়ার পানির গুনগত মান ঠিক থাকলে উক্ত আঁশেরও রং এবং মান ঠিকঠাক থাকে।

প্রক্রিয়াজাতকরন

জলে ধোয়া এই পাটতন্তু শতভাগ জীবানো বিরোধক, পুনঃ ব্যবহারযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব। পাট পুরোপুরি বর্ষাকালেরই ফসল। ভাল ফলনের জন্য মাসে কমপক্ষে আড়াইশ মিলিমিটার বৃষ্টি লাগে। বর্ষার ফসল হওয়ায় পাট কাটা থেকে শুরু করে আঁশ ছাড়ানো সব কাজ চলে বৃষ্টি বাদলের উৎপাত সহ্য করেই। দেশের ৪০ থেকে ৪৫ লাখ চাষী পত্যেক্ষভাবে জড়িত পাট চাষের সাথে।

পাট ও পাট পণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরন, বিপণনের সাথে জড়িয়ে আছে প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবন জীবিকা। কিছু ফেলনা নয় পাটের, আঁশ ছাড়ালে মিলে পাটখড়ি। পাট গাছ থেকে আঁশ  যা মেলে তার দ্বিগুন পাওয়া যায় পাটখড়ি। পাট খড়ি দিয়ে তৈরি হয় ঘরের বেড়া ও চাউনি। জ্বালনি হিসেবে পোড়ে এবং বাঁশ গাছের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় পার্টিক্যাল বোর্ড, কাগজের মন্ড এবং কাগজ তৈরিতে। আলাদা করা আঁশ এবার রোদে শুকানোর পালা। রোদে শুকালে ফুটে বের হয় পাটের আসল রং এবং উজ্জলতা। 

রোদে শুকানো পাট ও পাটখড়ি

পাটের আঁশ উজ্জল,নরম এবং চকচকে। ১ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। তোশা,দেশী,কেনাফ ও মেস্তার মধ্যে তোশা পাটের আঁশ সবচেয়ে সুক্ষ,মসৃন ও শক্ত। রোদে শুকানো আঁশের এবার গন্তব্য স্থানীয় বাজার কিংবা পাট ক্রয় কেন্দ্রে। পাটের আঁশ  বাজারজাত করা হয় তিন পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে ছোট বাজার দ্বিতীয় পর্যায়ে বড় বাজার তৃতীয় পর্যায়ে দেশীয় পাটকল বা বিদেশী বাজার। পাটের আশেঁর বাজারজাত প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখেন মধ্যসত্ত্বভূগী দালাল,বেপারী এবং আড়তদার। একসময় পাট ছিল বাংলাদেশের রাপ্তানী আয়ের প্রধান উৎস। এখন এটি দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকারী ফসল। 

২০১৭ সালে দেশের ৮.১৭ লাখ হেক্টর জমির পাট বাজারে যোগান দিয়েছে ৯২ লাখ ব্রেল আঁশ যা স্বাধীনতা পরবর্তী সর্বচ্চো। তুলার পর পাট বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আঁশ ফসল। বাংলাদেশে পাট পাটপণ্যের তাই বিশাল চাহিদা বিশ্ববাজারে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পন্যের মাধ্যেমে আয় হয়েছে ৯৬ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৩ থেকে ৪ শতাংশ আসে পাট ও পাটজাত  পন্য থেকে। বিশ্বের মোট উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে বাংলাদেশ। উৎপাদনের ৯০ শতাংশ রপ্তানি করে মেটায় বিশ্ব চাহিদার এক চতুর্থাংশ। সোনালী এই আঁশ বহুমূখী কাজে ব্যবহৃত হয়। পাটের আঁশ দিয়ে নানা রকম পাট পণ্য তৈরি হয় দেশের ২২ টি সরকারি, ১৯৭ টি বেসরকারি পাটকলে।

কলকারখানায় পাটের ভেজিটেবল ফাইভার টুকরো টুকরো করে কেটে  নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বানানো হয় পাট। পাট থেকে তৈরি হয় সুতা। বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা ও পরিবেশ বান্ধব ভেজিটেবল ফাইভার দিয়ে বানানো সুতলি, দড়ি, চট, বস্তাসহ রকমারি পাটপণ্য  তৈরির প্রধান উপাদান। অন্যান্য কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক আঁশের সাথে মেশানো যায় বলে কাপড় বোনার উপযোগী উন্নতমানের সুতাও তৈরি হয় পাট থেকে। পরিবেশ সচেতনতার কারনে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহার বাড়ায় দিনদিন বাড়ছে পাটতন্তুর কদর। বাড়ছে পাট পণ্যের উৎপাদন ও রাপ্তানিও। 


পাট দিয়ে তৈরি দড়ি

৫০টি দেশে ১৫ লাখ ৩০ হাজার টন পাটপণ্য রপ্তানি করে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে  বাংলাদেশের আয় ৮৯ কোটি ডলার। রংবাহারী পাট সুতার প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বহুমূখী পাট উৎপাদনে বিপ্লব এনেছে সরকারি জুট ডাইবারসিফেকেশান প্রমোশন  সেন্টার এবং বেসরকারি শিল্প উদ্যেক্তরা এবং তৈরি করেছে ২৪০ ধরনের আকর্ষনীয় পাট পণ্য। উৎপাদন, উন্নয়ন এবং বহুমূখীকরনের সুবাধে পাটের সোনালী আঁশ আবারো মর্যদা দখল করেছে বিশ্বসভায়।

Post a Comment

0 Comments