শীতে পদ্মা পাড়ের জনপদ

শীতের পদ্মা

নদীমাতৃক এই দেশে বয়ে চলা নদীর মতই ভিবিন্ন মৌসুমে নদী গুলো হাজির হয় তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে। কখনো তার ভয়াল রূপ আবার কখনো তার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য ঢেলে এই প্রকৃতির মাঝে।গ্রীষ্মের বালুচর,নববর্ষায় নীল,ভরা বর্ষায় গৌরী,শরতে আসমানি,শীতের সবুজ ঘেষা আর শীতান্তে দূরে শাড়ি গায়ে জড়ানো তত্নী কিশোররীর মত চঞ্চল চরনে বয়ে চলা এই নদী সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড়ো ভালবাসি। প্রিয় বন্ধুরা ভালবাসার সেই নদীরূপ দেখতে আজ আমরা হাজির হলাম শীতার্ত পদ্মা পাড়ে। প্রমত্তা পদ্মার বুক ভরা মৌসুমে থাকে দুরন্তপনার তান্ডবে।কিন্তু শীতে তার ভয়াল রূপ মলিন হয় নুয়ে পড়া গাছের ভঙ্গিমায়। এই দেশ জুড়ে ছোটবড় অগনিত নদ-নদী, ছড়িয়ে আছে জালের মত। বহতা পদ্মা নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রধান তিন নদীর একটি।

পদ্মার বয়ে চলা পথ দেশের অন্যতম প্রধান নৌপথ। নদীর বুকে তাইতো শত শত নৌযানের আসা যাওয়া। পদ্মার নৌপথে নৌযান যেমন অগনিত তেমনি দুই পাড়ে খেয়াঘাট, ফেরীঘাট আর নৌবন্দরও অসংখ্য। পদ্মাপাড়ের বিখ্যাত ঘাট গুলোর একটি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ফেরীঘাট। মাওয়াঘাট সবার এত পরিচিত কেন জানেন. দেশের দাক্ষিন ও দক্ষিন-পশ্চিম  যাওয়ার জন্য মাওয়া রুট ব্যবহার করায় সড়ক পথের দুরত্ব কমেছে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। মাওয়াঘাট থেকে ফেরী ও দূরপাল্লার লঞ্চ যায় শরিয়তপু, ফরিদপুর, মাদারিপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ ও খুলনায়। দৈনন্দিন ঘর গৃহস্থালি কিংবা জেলেদের জীবিকার রসদ খোঁজা সব কাজে নদী এখানে প্রধান সহায়ক। অনেক বালুর যোগান দে পদ্মা, তাইতো ঘাটে ঘাটে বালুর স্তুপ। ঘাট মানে অনন্য এক জগৎ। সেই চেনা দৃশ্য, চেনা হাঁকডাক, জীবন ও জীবিকার চিরচেনা আয়োজন। 

শুকনো পদ্মা

গঙ্গা এবং পদ্মা একই নদীর দুই নাম। উজানের গঙ্গা ভাটিতে এসে হয়েছে পদ্মা। হিমালয়ের গঙ্গত্রি হিমবাহ থেকে নেমে বহু পথ পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে বহতা এই ধারা দেশের মাঝ  বরাবর বয়ে গেছে পশ্চিম থেকে পূর্বে। শীতেও বহুরূপী পদ্মার গতিবিধি বুঝা যায় না। কোথাও সে শান্ত কোথাও বা চঞ্চল। পদ্মা চর জাগা নদী, তাই ছোট বড় অগনিত চর। এর চর কোনগুলা ৫/৬ কিলোমিটা পর্যন্ত লম্বা। মন্থরগতির কারনে নিন্ম অংশে পলি জমে জমে পদ্মার বুকে জন্ম এসব চরের। জীবিকার তাগিদে বিরাম চরেও কর্মব্যস্ত নদীজীবি মানুষ। জনবিরল চরে বিরক্তকরাও কেউ নেই। তাইতো শীতের সময় পদ্মার চর হয়ে উঠে অতিথি আর অন্যান্য পাখিদের অভয়ারণ্য। চরতো নয় যেন জলে ভাসা একটুকরো দ্বীপ। 

নদীতল থেকে জেগে উঠা নতুন এসব চর বর্ষায় ডুবে থাকে জলে। জলে টান ধরলে জেগে উঠে শুকনো মৌসুমে। পদ্মা শুধু গড়ে না ভাঙ্গেও। কখনো কখনো আগ্রাসী এই নদী গ্রাস করে নিজেরই গড়া শতশত জনপদ। পদ্মার ছোবলে পায়ের নিচের মাটি বার বার হারালেও থেমে থাকে না জীবনের জোয়ার। নদীপাড়ের মানুষ নদীর সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে লেনদেনের নিবিড় বাঁধনে। চরের বুকে দেখা মেলে কাঁশফুলের ঢেউ। চমৎকার সাদা কাঁশ যেন সকল আশা আকাঙ্খার রং, চারদিকে চড়ায় শুভ্রতার শান্তি। সর্বোস্ব কেড়ে নেওয়ার সময় পদ্মা যেমন কার্পণ্য নেই তেমনি দেওয়ার বেলায় ও পদ্মা দরাজহস্ত। পদ্মাপাড়ের ফসলের প্রাচুর্য দেখে মনে হবে পদ্মার পানি ও পলির কেমন গুন। একদিকে উর্বর মাটি তার উপর নদীর পানি দুই মিলে তাই দারুন ফলন। 

এখানকার কৃষকরা জানালেন চরের আবাদি জমি দোফসলি পানি ও পলির কারনে বেশ একটা বাড়াতি যত্ন লাগে না। তাই তো বিঘা প্রতি ধান হয় দশ থেকে বারো মন। প্রযুক্তির ছোঁয়া এসেছে পদ্মার চরেও,ধান মাড়ানোর জন্য সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে রয়েছে নিত্য নতুন ধান মাড়ানোর মেশিন। তবে সনাতন পদ্ধতিতে ধান মাড়ানো হয়। মাদারিপুর  জেলার শিবচর উপজেলায় নদী জাগা চরে গ্রাম আছে অগনিত। চরে হলেও আট দশটা গ্রামের মতই প্রতিদিনের জীবন এখানে স্নিগ্ধ, সুন্দর সহজ। এখানে কারো মাথা গোজার ঠাঁই কারো টিনের কারো বা চন,  বেড়া, পাটখড়ির। পদ্মার কথা জিজ্ঞেস করায় এখানকার গৃহবধুরা জানালেন কড়াইয়ের মাছ এবং সবজি দুটোই মিলেছে নদীর টানে। গ্রামের গৃহকর্তীরা জানালেন তারা এখানে আছেন ২৫ বছর ধরে। মুলত  নদীভাঙ্গা মানুষ জনই জীবন জীবিকার তাগিদে ঠাঁই গড়ে চরে। ভাঙ্গনপ্রিয় নদীর রুঢ় বাস্তবতা ওদের কাছ থেকে অর্থ বিত্ত, টাকাপয়সা কেড়ে নিলেও জীবনধারর স্নিগ্ধতা কেড়ে নিতে পারে না একটুও। ভাঙ্গন প্রবন নদীর স্বভাব জানে নদী পাড়ের মানুষ, তাইতো পাকা বাড়ি এখানে নাই বললে চলে। কেড়ে নেওয়ার ক্ষয়ক্ষতিটা নদী অবিশ্য পুষিয়ে দে নানান ভাবে। শীতকালীন শাক সবজি, লাউ কুমড়োর অভাব নেই এখানে। এখানকার ছোট ছেলেমেয়েরা পড়তে যায় শিবচরের স্কুলে। 

নদীতে মাছ শিকার

চরের জমিতে মৌসুমি ধানের বাড় বাড়ন্ত ফলন। গবাদি পশুর খাবাড় যোগাতে খড়েরও তাই অভাব নাই। শুকনো মৌসুমে পদ্মার জল প্রবাহ ১৫ হাজার কিউসিক থাকলেও বর্ষায় সেটা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে সাত লাখে। দেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ জমির সেচ কাজ চলে এই নদীর পানি দিয়ে। পদ্মা নদীর ড্রেনেজ এরিয়া প্রায় ৪৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে। দক্ষিন পশ্চিমের জেলা গুলাকে এই নাদী আলাদা করে রেখেছে দেশের বাকি জেলাগুলা থেকে। উজানের গঙ্গা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ২৫৮ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছে গোয়ালন্দ পর্যন্ত। গোয়ালন্দ থেকে যমুনার পানি বুকে নিয়ে পদ্মা নামের আরও ১২০ কিলোমিটার পার হয়ে মিশেছে চাঁদপুরের মেঘনায়। মহাগঙ্গা, টাঙ্গুর, পুনর্ভবা, নাগর পদ্মার উপনদী। মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ, মাথাভাঙ্গা, চিত্রা, কপোতাক্ষ, গড়াই, কিত্তনখোলা এবং পশুর পদ্মার শাখা নদী। 

শুকনো মৌসুমে জলের টান ধরে বেশি তাই এসময় মাছ ধরার আয়োজনটাও এসময় চোখে পড়ে বেশি।পদ্মার ইলিশ,বোয়াল আর পাঙ্গাসের অতুলনীয় স্বাদের খ্যাতি একসময় শোনা যেত সবার মুখে। মাছের পরিমান আর স্বাদ দুটোই নাকি কমছে দিনদিন। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় পদ্মায় চলাচল কমে গেছে  সাগর ফেরত ইলিশের। পরিবেশের বিপর্যয় আর নিয়ম না মেনে মাছ ধরার কারনে কমে গেছে অন্য মাছের প্রাচুর্যও। এখন তাই মাছের মৌসুমেই মাছ মেলে জেলেদের জালে। পদ্মা পাড়ের পেশাজীবিদের একটা বড় বংশ জীবিকা চালায় মাছ ধরে। দিন বদলের পালায় প্রকৃতি বদলায়, পাল্টে যায় পদ্মারও রূপ। গ্রীষ্ম,বর্ষা,শীত,শরৎ পদ্মার রূপের অন্ত নেই কোন, সে শুধু ভাল লাগায় মুগ্ধ করে আর ভালবাসায় হৃদয়কাড়ে। সৌন্দর্য্যের সবটুকু বিলিয়ে দেয় সবার মাঝে।


Post a Comment

0 Comments